বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব, আদালত এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সম্পর্কিত হিসাব যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকা অডিটররা বর্তমানে বড় ধরনের একটি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান এই আন্দোলনের মূল দাবি হচ্ছে, ১১তম গ্রেডের পদ থেকে তাদের ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ। তবে এই দাবির পূরণ না হওয়ায় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম, বিশেষ করে বেতন-ভাতা প্রদানের প্রক্রিয়া, বর্তমানে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
অডিটরদের দাবি, তাদের পদকে ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ একটি ন্যায্য অধিকার এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়ও রয়েছে। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে যে, অডিটরদের ১০ম গ্রেডের সুবিধা দেওয়ার কথা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদোন্নতি এখনো হয়নি, যা অডিটরদের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করছেন, কিছু অদৃশ্য শক্তি এবং সিন্ডিকেট এই পদোন্নতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
অডিটরদের পদটি বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণির আওতাভুক্ত এবং ১১তম গ্রেডের অধীনে রয়েছে। ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয় যে, অডিটরদের ১০ম গ্রেডের সুবিধা দিতে হবে। তবে এই রায় অনুসারে শুধুমাত্র ৬১ জন অডিটরের ক্ষেত্রে ১১তম থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণের ব্যবস্থা করা হয়, যা প্রায় ৬,৯২৪ জন অডিটরদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে।
অডিটররা দাবি করছেন যে, তাদের পদের উন্নীতকরণ হওয়া উচিত, শুধুমাত্র বেতন নয়। তাদের মতে, একই পদে চাকরি করেও কেউ ১০ম গ্রেডের বেতন পাচ্ছেন, আর কেউ ১১তম গ্রেডের বেতন পাচ্ছেন, যা চরম বৈষম্য।
অডিটরদের আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, তারা মনে করছেন অডিট ক্যাডার কর্মকর্তারা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন। অডিটররা মনে করেন, যদি ১০ম গ্রেড বাস্তবায়িত হয়, তবে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এর মাধ্যমে পরিচালিত হবে এবং এতে অডিট ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া, ১০ম গ্রেড বাস্তবায়িত হলে অডিট ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অডিট ক্যাডার এবং অডিটরদের মধ্যে চলমান এই বিরোধ এবং অডিট ক্যাডার কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আন্দোলনের জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অডিটররা মনে করেন, অডিট রিপোর্ট পরিবর্তন করার ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় ক্যাডার কর্মকর্তারা ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন চান না। এর ফলে, অডিটরদের পদোন্নতি এখনো ঝুলে আছে।
অডিটরদের দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলন সরকারি কার্যক্রমে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ৪৩টি মন্ত্রণালয়, বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন মিশন, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব অডিট না হওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি হিসাব যাচাই না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় বেতন ছাড়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে না, যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে।
অডিটররা অভিযোগ করেছেন যে, অর্থ মন্ত্রণালয় আদালতের রায় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক মতামত সত্ত্বেও তাদের দাবি পূরণে বারবার গড়িমসি করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পরপর দুই ধরনের চিঠি জারি করা হয়েছে, যা অডিটরদের মতে আদালত অবমাননার শামিল। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অডিটরদের ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার নির্দেশ দেওয়া হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র ৬১ জনের ক্ষেত্রে এই রায় কার্যকর করে, যা অন্যান্য অডিটরদের জন্য বৈষম্যের সৃষ্টি করে।
অডিটরদের আন্দোলনের মুখপাত্র আহমেদুর রহমান ডালিম বলেন, “আমাদের দাবি ১০ম গ্রেড নয়, এটি আমাদের অধিকার। আদালতের রায়ে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের গড়িমসি আমাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আমরা চাই আমাদের পদের আপগ্রেডেশন, শুধু বেতনের নয়।”
অডিটররা মনে করেন যে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কোনো অদৃশ্য শক্তি বা সিন্ডিকেট তাদের দাবি মেনে নিতে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা অভিযোগ করেছেন যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করতে এবং সরকারি কার্যক্রমে অস্থিরতা তৈরির জন্য এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
অডিটররা দাবি করেছেন যে, তাদের পদের আপগ্রেডেশন হলেই তারা কাজে ফিরে যাবেন। তারা আশা করছেন, সরকার তাদের বৈধ দাবি পূরণ করবে এবং সরকারি কার্যক্রমে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুত দূর হবে।
অডিটরদের আন্দোলন এবং তাদের ১১তম থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার দাবির জটিলতা বর্তমানে সরকারি কার্যক্রমে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। আদালতের রায় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক মতামত থাকা সত্ত্বেও, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া অডিটরদের হতাশ করছে এবং তাদের কর্মবিরতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
সরকারের উচিত অডিটরদের ন্যায্য দাবি পূরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় এবং সরকারি কার্যক্রমে আর কোনো বিঘ্ন না ঘটে।