ঢাকা, বাংলাদেশ – বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে অস্থিতিশীলতার মধ্যে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের লুকিয়ে থাকা এবং দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের অন্তত ২৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। কারো কারো অভিযোগ, এসব কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তাদের অবস্থান অজানা, তবে কেউ কেউ দেশত্যাগ করেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম নাম উঠে এসেছে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং এডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদারের। তারা আত্মগোপনে রয়েছেন এবং তাদের অবস্থান নিয়ে এখনও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। এদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
আলোচনায় আরও এসেছে ঢাকা জেলার সাবেক ডিআইজি শহীদ নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ হারুন-অর-রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব সরকার, মিডিয়া সেল প্রধান খন্দকার নুরুন্নবী এবং সঞ্জিত কুমার রায়ের নাম। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে, কিন্তু তাদের কেউই এখন পুলিশের অধীনে নেই এবং তাদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে শুরু করে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, জনগণের প্রতিবাদ এবং সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাই আত্মগোপনে চলে যান। সরকার পতনের পর পুলিশের অধিকাংশ কর্মকর্তা নিজেদের জীবন রক্ষায় আত্মগোপনে চলে গেছেন, বলে দাবি করেছে বিভিন্ন সূত্র। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি দল যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তারা ৫ আগস্টের আগে থেকেই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নিজেদের সুরক্ষার পরিকল্পনা করছিলেন।
প্রাক্তন আইজিপি মনিরুল ইসলাম, যার বিরুদ্ধে হত্যা এবং গুমের অন্তত ৫০টি মামলা রয়েছে, তিনি এখনও ধরা পড়েননি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় যে, ৫ আগস্টের বিকেলে পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি হেলিকপ্টারে মনিরুলকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় গণহত্যা, গুম, ও রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা মহানগরের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, জুলাই মাসে আন্দোলনের সময় ঢাকায় প্রাণহানির ঘটনায় তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। হাবিবুর রহমান গোপালগঞ্জের বাসিন্দা এবং তার নামও পালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের মতে, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে যাওয়া প্রায় ৪০০ পুলিশ সদস্য এখনও কাজে যোগদান করেননি। তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন পদমর্যাদার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের একাংশ নতুন সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও, অধিকাংশই আত্মগোপনে রয়েছেন। কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযোগের পরও তাদের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমনকি ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, তারা সীমান্ত পার হয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন, যদিও এই তথ্যের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জনে বলা হয়েছে, প্রাক্তন আইজিপি মনিরুল ইসলাম একটি হামলায় গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে রয়েছেন। অন্যদিকে, মনিরুল ইসলামসহ কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাকে এখনও আইনের আওতায় আনা যায়নি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর পুলিশের ওপর জনসাধারণের আস্থা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এখন নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার এবং যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুলিশের এই ধরনের কর্মকাণ্ড স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবেরই প্রমাণ। সরকার পরিবর্তনের পর, নতুন প্রশাসন পুলিশি সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।