রাজধানীর সাইন্সল্যাব এলাকা। দিনের আলো ঝাপসা হয়ে আসছে, ছাত্রদের ক্ষোভ, রাস্তায় নেমে আসা। যে স্থানে তাদের স্বপ্ন জ্বলছিল, সেখানে হঠাৎ করে পরিণত হলো এক ভয়াবহ রণক্ষেত্রে। এক দিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা, অন্য দিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। মুহূর্তের মধ্যেই সাইন্সল্যাব এলাকায় নেমে আসে এক ভয়াবহ তাণ্ডব। আর এই তাণ্ডবের শিকার হলেন ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের মেধাবী ছাত্র সবুজ আলী। তার জীবনের শেষ অধ্যায় লিখিত হলো এক নির্মমতার কাহিনীতে, যা জাতির হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষত হিসেবে থেকে যাবে।
নির্মমতার শিকার সবুজ: লাঠির আঘাতে থেমে গেলো সবুজের জীবন
সবুজ আলী। ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। অত্যন্ত মেধাবী এবং সৎ ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পড়াশোনার খরচ চালাতে রিকশা চালাতেন। স্বপ্ন ছিল পরিবারের দুঃখ দূর করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু তার স্বপ্ন যেন নিষ্ঠুর সময়ের হাতে ধ্বংস হয়ে গেলো।
বিক্ষোভের দিন, ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে বিক্ষোভের সময় লক্ষ করে নির্মমভাবে আঘাত করতে শুরু করে। তার লজ্জাস্থানে প্রচণ্ড জোরে লাঠি ও লাথি মেরে তাকে আহত করে। সবুজের শরীর ভেঙে পড়ে, কিন্তু আঘাত থামেনি। তার মুখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে তার দেহ। বিক্ষোভের উত্তেজনা, শোরগোলের মাঝখানে সবুজের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো যেন আকাশে মিলিয়ে যায়।
জানাজা ও রাজনীতি: মৃত সবুজের লাশের উপর চলে অমানবিক রাজনীতি
সবুজের মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ মর্মাহত হয়। তার সহপাঠীরা, কলেজের শিক্ষকরা, সবাই তাকে একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবেই জানতো। কিন্তু ছাত্রলীগ তার মৃত্যুতে নিজেদের কর্মী হিসেবে দাবি করে জানাজার আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
সবুজের ভাই জানাজায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সেখানে তাকে স্তম্ভিত হতে হলো। তিনি বুঝতে পারলেন, তার মেধাবী ভাইয়ের লাশ নিয়ে চলছে অমানবিক রাজনীতি। সবুজ কখনো ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাধারণ ছাত্র, রিকশাচালক, পরিবারের আশার আলো। কিন্তু তার লাশকে ব্যবহার করে ছাত্রলীগ জনমত নিজেদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছে। তার মৃতদেহকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানো হচ্ছে।
সবুজের পরিবারের কান্না: রিকশাচালক মেধাবী ছেলের জীবনের শেষ কাহিনী
সবুজের পরিবার। তার মা-বাবা, ভাইবোন—সবার চোখে জল। তাদের একমাত্র আশার আলো ছিল সবুজ। তার বাবা-মা আশায় ছিলেন যে সবুজ পড়ালেখা করে মানুষ হলে তাদের দুঃখ দূর হবে। তার মা আজও মনে করেন, তার ছেলে ঘরে ফিরে আসবে, কিন্তু বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে তার এই আশা ভঙ্গ হয়েছে।
সবুজের বড় ভাই বলেন, “সবুজ পড়ালেখা করে মানুষ হলে আমাদের পরিবারের দুঃখ দূর হবে।” আজ সবুজ নেই, তার স্বপ্ন নেই, তার পরিবারের আশাও নেই। কিন্তু থেকে গেছে এক অমানবিকতার ইতিহাস, এক নির্মম ঘটনার স্মৃতি।
ন্যায়বিচার কি পাবে সবুজ?
সবুজের ভাই নিউমার্কেট থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু নানা জটিলতা ও ভীতি তাকে মামলা করতে দিচ্ছে না। তিনি চান তার ভাইয়ের জন্য ন্যায়বিচার, কিন্তু রাজনীতি, ক্ষমতার জালে আটকেছেন তিনি। ন্যায়বিচারের জন্য চিৎকার করলেও তার কণ্ঠস্বর যেন ঢাকা পড়ছে বড় বড় নেতাদের শোরগোলে।
জাতির প্রশ্ন: সবুজের মতো আর কতজন?
সবুজের মৃত্যুতে কাঁপছে জাতির হৃদয়। প্রশ্ন উঠছে—এখনও কত সবুজ, কত নিরপরাধ ছাত্রকে রাজনীতির শিকার হতে হবে? কেন মেধাবী ছাত্রদের জীবনের এমন নিষ্ঠুর সমাপ্তি ঘটবে? সবুজের মতো আর কতজন নিরপরাধ ছাত্রের স্বপ্ন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হবে?
সবুজের মতো ছেলেদের জন্য ন্যায়বিচার কি আদৌ পাওয়া যাবে? তার লাশের উপর রাজনীতি কি বন্ধ হবে? নাকি সবুজের মৃত্যুও একদিন ভুলে যাবে সবাই, আর তার মতো অন্য সবুজরা হয়ে উঠবে রাজনীতির পুতুল?
উপসংহার
সবুজের নির্মম মৃত্যু জাতির কাছে একটি প্রশ্ন রেখে গেছে—কেন নিরপরাধ ছাত্রদের জীবন এমনভাবে শেষ হয়? তার মায়ের কান্না, ভাইয়ের ক্ষোভ, বন্ধুরা, সহপাঠীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি কোনোদিন থামবে? নাকি সবুজের মৃত্যুতে রাজনীতির খেলায় নতুন কৌশল তৈরি হবে? এই জাতির কাছে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি। সবুজের মতো আর কতজনকে রাজনীতির নির্মম শিকার হতে হবে? তার মৃত্যু যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়, আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে। সবুজের মৃত্যু যেন অর্থহীন না হয়।