ডেস্ক রিপোর্ট, সকলের কণ্ঠ
দেশের অর্থনীতির প্রাণ পোশাক শিল্প এখন একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপর্যস্ত। মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম, ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ধামরাইয়ের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানায় ভয়াবহ আগুনে শত শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত গার্মেন্টস শিল্প। এসব ঘটনায় ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও রফতানিকারকদের মধ্যে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, ধারাবাহিক এসব আগুনকে নিছক দুর্ঘটনা না ভেবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে গার্মেন্টস খাতকে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে—যাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়।
বিগত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের ভেতরে-বেড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা এবং নাশকতা-সদৃশ ঘটনাগুলোর ঘনঘটা বাড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র শক্তিগুলো দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের নতুন কৌশল হিসেবে এখন শিল্পখাতকে ব্যবহার করছে।
তাদের মতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই ‘দিল্লি-সংঘাত’ নতুন রূপ নিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রভাববলয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন অর্থনৈতিক খাতগুলোকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টার অংশ হিসেবেই এই অগ্নিকাণ্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে।
১. বৃহস্পতিবার: চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) ভয়াবহ আগুনে একাধিক গার্মেন্টস কারখানা ধ্বংস হয়। ১৭ ঘণ্টা চেষ্টার পর সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
২. শনিবার: ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন লাগে। রফতানির জন্য প্রস্তুত পোশাক, কাঁচামাল ও শতাধিক মূল্যবান স্যাম্পল ধ্বংস হয়।
৩. রবিবার: ঢাকার ধামরাইয়ে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে। পাশাপাশি সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর সড়কে নজরুল মার্কেটেও অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
এই ধারাবাহিকতা বিশ্লেষকদের মতে, নিছক দুর্ঘটনা নয়—বরং পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ধ্বংসযজ্ঞের ইঙ্গিত বহন করছে।
গত শনিবার দুপুরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনে রফতানির জন্য প্রস্তুত পোশাক, তৈরির কাঁচামাল ও বিপুল সংখ্যক বিজনেস স্যাম্পল পুড়ে যায়।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান জানান—
“এই আগুন দেশের পোশাক খাতের জন্য এক মহাবিপর্যয়। হাই-ভ্যালু পণ্য, জরুরি শিপমেন্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পল—সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। এই স্যাম্পলগুলোই ভবিষ্যতের নতুন অর্ডার ও বিজনেস ডেভেলপমেন্টের মূল হাতিয়ার। সেগুলো হারানো মানে ভবিষ্যৎ বাজার হারানো।”
বিজিএমইএ ইতিমধ্যে সদস্যদের কাছ থেকে ক্ষতির পরিমাণ জানাতে চিঠি দিয়েছে এবং অনলাইন পোর্টাল খুলেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি।
🚫 ফায়ার সার্ভিস আটকে দেওয়া হয়েছিল কেন?
অগ্নিকাণ্ডের পর একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানবন্দরের ৮ নম্বর ফটকের সামনে পৌঁছালেও তাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ডিএইচএল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেন—
“ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো ২০ থেকে ২৫ মিনিট ফটকের বাইরে আটকে ছিল। এই সময়েই আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।”
এ ঘটনায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন তাদের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ টিম সময়মতো পদক্ষেপ নেয়নি, তা নিয়েও চলছে তীব্র সমালোচনা।
🏭 ব্যবসায়ীদের ভয়—‘দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’
বিজিএমইএ পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন—
“রফতানির জন্য প্রস্তুত পণ্য, কাঁচামাল ও স্যাম্পল পুড়ে যাওয়ায় দেশের পোশাক খাত বিশাল ক্ষতির মুখে। বিদেশি ক্রেতারা এখন আতঙ্কিত। তারা জানতে চাইছেন—বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত আছে কি না।”
তিনি আরও জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানি-রফতানিকারকদের জন্য তাৎক্ষণিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। টার্মিনাল ৩-এ নতুন স্থান বরাদ্দ ও ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে মালামাল ছাড়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকার আগামী তিন দিন নন-সিডিউলড ফ্লাইটের সব চার্জ মওকুফ করেছে।
💰 ‘শত কোটি টাকার’ আমদানি পণ্যও পুড়ে গেছে
কার্গো ভিলেজের বাইরে ক্ষুব্ধ আমদানিকারকদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। অনেকে ফোনে ক্ষতির খবর জানতে চেষ্টা করছিলেন।
সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধি আলাল আহমেদ বলেন—
“আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ হাজার ডলারের মালামাল ছিল, সব পুড়ে গেছে।”
অন্য একজন প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেন জানান—
“আমাদের ক্লায়েন্ট ভিভো মোবাইলের প্রায় ১০ হাজার কেজি যন্ত্রাংশ পুড়ে গেছে। আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।”
প্রতিদিন বিমানবন্দরের মাধ্যমে প্রায় চার হাজার বিল অফ এন্ট্রি বা আমদানি চালান আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অগ্নিকাণ্ড সাময়িকভাবে দেশের বাণিজ্য প্রবাহকে অচল করে দিয়েছে।
আগুনের কারণ উদ্ঘাটনে বিমান বাংলাদেশ, কাস্টমস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় আলাদা তদন্ত কমিটি করেছে। তবে ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন—কেন ফায়ার সার্ভিসকে সময়মতো ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি, এবং কেন বেবিচকের টিম নিষ্ক্রিয় ছিল?
বিশ্লেষকদের মতে, আগুনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের আচরণ সন্দেহজনক। কেউ কেউ বলছেন, এটি “রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ”।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের পোশাক খাত আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত উত্থান ঘটাচ্ছে। মার্কিন প্রশাসনের চীনা ও ভারতীয় পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের পর থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব ক্রেতাদের কাছে নতুন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতি ভারত পছন্দ করছে না বলেই মনে করছেন অনেকেই। তারা বলছেন—
“ভারত এক সময় শ্রীলংকার গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। এখন একই কৌশলে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে অস্থির করতে চাইছে।”
ভারতের কূটকৌশল ও বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক প্রভাববলয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় তাবেদারদের মাধ্যমে তারা এখন ‘ইকোনমিক টেররিজম’-এর পথ নিচ্ছে—অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।
🧩 গার্মেন্টস শিল্প কেন টার্গেট?
১. বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস: বছরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় আসে গার্মেন্টস খাত থেকে।
২. চাকরির বাজার: প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।
৩. আন্তর্জাতিক প্রভাব: পোশাক রফতানি বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
৪. বিনিয়োগ প্রবাহ: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও ইউরোপীয় ক্রেতারা নতুন করে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
এসব কারণেই গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করলে পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে—এমন আশঙ্কা থেকেই বিশ্লেষকরা বলছেন, “টার্গেট গার্মেন্টস, উদ্দেশ্য নির্বাচন ঠেকানো।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহল বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিল্প অবকাঠামোকে ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ক্ষমতা হারানোর পরও বিদেশে বসে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের কৌশল নিচ্ছে তারা।
তাদের মতে, গার্মেন্টস খাতে বারবার আগুন লাগার ঘটনা শুধু ব্যবসায়ীদের ক্ষতি নয়, বরং দেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
“বাংলাদেশে নিরাপত্তা নেই, বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ”—এমন বার্তা ছড়িয়ে বিদেশি বায়ারদের নিরুৎসাহিত করাই মূল লক্ষ্য।
আগুন লাগার সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ফটকে আটকে দেওয়া এবং বেবিচকের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যদি এটি নিছক দুর্ঘটনা হয়, তবে কেন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়নি?
কেন বিমানবন্দর মতো কেপিআই এলাকায় এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারলো?
এসব প্রশ্নের উত্তর না মিললেও দেশের ব্যবসায়ী সমাজ বলছে—এটি কেবল আগুন নয়, বরং একটি ‘অর্থনৈতিক হামলা’।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছেন,
“ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করে অনুসন্ধান চলছে।”
সরকার ইতিমধ্যে চারটি তদন্ত কমিটি করেছে। তবে ব্যবসায়ী সমাজ মনে করছে, কেবল তদন্ত নয়—এই ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের পেছনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রণোদনা উন্মোচন করা জরুরি।
অর্থনৈতিক কূটনীতির গবেষকরা বলছেন, এই ঘটনাগুলো যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন করে বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে পারে। এতে বিনিয়োগ, অর্ডার, এমনকি বাণিজ্য নীতি—সবই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে।
ইতিমধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বায়ার প্রতিনিধি এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে অতিরিক্ত আশ্বাস চাইছেন।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু অর্থনীতির প্রাণ নয়, এটি স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বড় সফলতা।
এই শিল্প আজ পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ডে বিপন্ন।
দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের এই চক্রান্তকে যদি এখনই মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে এর ফলাফল হবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব ও আন্তর্জাতিক আস্থাহীনতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন—
“এই আগুন শুধু পণ্য পুড়াচ্ছে না, এটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে পুড়িয়ে দিচ্ছে।”