জুলাইযোদ্ধাদের দায় নিতে হবে কেন? প্রশ্ন তুললেন সালাহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতিক সালাহউদ্দিন আহমেদ। শুক্রবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য— ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বিষয়ক আমার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। জুলাইযোদ্ধারা কেন বিশৃঙ্খলার দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে চাচ্ছে?— এই কয়েকটি বাক্য ঘিরেই শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও এই বক্তব্য নিয়ে চলছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মতবিভেদ। কেউ বলছেন, তিনি আন্দোলনের সমালোচনা করেছেন; কেউ বলছেন, তার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি বরাবরই কর্তৃত্ববাদী ও দমননীতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ শব্দবন্ধটি আরও তীব্র—এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, এমন কেউ যিনি পরোক্ষভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে স্বৈরাচারের সহযোগী।
সালাহউদ্দিন আহমেদ গত সপ্তাহে এক টেলিভিশন টকশোতে বলেছিলেন,
“জুলাই আন্দোলনের চেতনা বিকৃত করা হচ্ছে। যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে দেশকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে, তারাই আসল ফ্যাসিস্টের দোসর।”
কিন্তু পরদিন কিছু সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বক্তব্য আংশিকভাবে প্রচারিত হয়, যেখানে বলা হয় তিনি ‘জুলাইযোদ্ধাদের ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলেছেন। এখান থেকেই শুরু হয় বিতর্ক।
পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন,
“আমার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমি কোনো আন্দোলন বা সংগঠনকে আক্রমণ করিনি। বরং যারা গণতন্ত্রের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদেরই আমি ফ্যাসিস্টের দোসর বলেছি।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হলো জুলাই আন্দোলন। এটি শুরু হয়েছিল মূলত তরুণ প্রজন্মের দাবিতে—নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনে নিরপেক্ষতা, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে।
কিন্তু আন্দোলনের শেষ দিকে সহিংসতা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সরকারি পক্ষ দাবি করে, আন্দোলনের মধ্যে অরাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ঢুকে পড়েছে। অন্যদিকে আন্দোলনের নেতারা বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে আন্দোলন দমন করতে সহিংসতা উস্কে দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দিন আহমেদের মন্তব্য অনেকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে বলেই ধরে নেয়, যদিও তিনি নিজে সেটি অস্বীকার করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন,
“রাজনীতিতে মতভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার বক্তব্য বিকৃত করে জনগণের কাছে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। আমি জুলাই আন্দোলনের লক্ষ্য ও চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু যারা আন্দোলনের নামে নাগরিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, তারাই আসল ফ্যাসিস্টের দোসর।”
তিনি আরও বলেন,
“জুলাইযোদ্ধারা যদি সত্যিকারের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে তারা কেন বিশৃঙ্খলার দায় নিজের কাঁধে নিতে চাইছে? আমি চাই না এই আন্দোলন কোনোভাবে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির ছায়ায় ঢেকে যাক।”
“জুলাইযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ” নামের একটি সংগঠন এক বিবৃতিতে বলেছে,
“সালাহউদ্দিন আহমেদের মতো একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছ থেকে আমরা এমন বক্তব্য আশা করিনি। আমাদের আন্দোলন ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। তাই আমাদের ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলা অন্যায়।”
তবে সংগঠনের আরেকাংশ কিছুটা সংযত ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা মনে করে, হয়তো বক্তব্যটি ভুলভাবে প্রচারিত হয়েছে। তারা আহ্বান জানিয়েছে, উভয় পক্ষের উচিত বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বসা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হুমায়ুন কবির বলেন,
“বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ এতটাই মেরুকৃত যে, একটি শব্দই বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। সালাহউদ্দিন আহমেদের মতো রাজনীতিকদের বক্তব্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে প্রচার করা হতে পারে। এর পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকতে পারে।”
অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক শারমিন আজাদ বলেন,
“আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বক্তব্য বিকৃত করা একটি বড় সমস্যা। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্যের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে উদ্ধৃতি প্রচার করা হয়। এতে জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।”
সালাহউদ্দিন আহমেদের মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
একদল ব্যবহারকারী লেখেন,
“জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের অপমান করা হয়েছে, এ বক্তব্যের জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
অন্যদিকে কেউ কেউ বলেন,
“তিনি আসলে ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থানই নিয়েছেন, মিডিয়া বিকৃত করেছে।”
এই দুইমুখী প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়, জনগণের একাংশ বক্তব্যের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারেনি, কারণ প্রচার ছিল অসম্পূর্ণ ও প্রসঙ্গবিচ্ছিন্ন।
বাংলাদেশে এখন ‘হাফ ট্রুথ নিউজ’ বা ‘আংশিক সংবাদ’ একটি পরিচিত প্রবণতা হয়ে উঠেছে। একটি বড় বক্তব্য থেকে মাত্র কয়েকটি শব্দ কেটে প্রচার করা হয়, যার মাধ্যমে অন্য অর্থ তৈরি হয়।
সালাহউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ এক সহকারী জানান,
“তিনি টেলিভিশনে প্রায় পনেরো মিনিট কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রচারিত হয়েছে মাত্র বিশ সেকেন্ডের একটি অংশ, তাও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বিকৃতি ঘটেছে।”
এমন উদাহরণ দেশে নতুন নয়—বিগত বছরগুলোতেও অনেক রাজনীতিক এমন অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বক্তব্য বিকৃতি একাধিক বড় ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
২০১৩ সালে এক মন্ত্রীর বক্তব্য ভুলভাবে প্রচারিত হলে তা নিয়ে সারাদেশে বিক্ষোভ হয়। পরে মিডিয়া ভুল স্বীকার করে।
২০২১ সালে এক জনপ্রিয় নেতার বক্তব্যের ভিডিও কাটছাঁট করে প্রচারিত হয়, যা পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়।
এমনকি স্বাধীনতার পরও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা একে অপরের বক্তব্য বিকৃত করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য বিকৃতির ঘটনা যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই শব্দটি ব্যবহার মানেই একটি পক্ষকে গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা।
এই শব্দের প্রয়োগ অনেক সময় প্রতিপক্ষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্যও ব্যবহৃত হয়।
তাই কোনো ব্যক্তি বা আন্দোলনকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলা হলে সেটি শুধুমাত্র ভাষাগত নয়, বরং রাজনৈতিক ঘোষণার সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।
এ কারণেই সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য ঘিরে এত বড় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে
এই বিতর্কের ফলে জুলাই আন্দোলনের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
কেউ কেউ মনে করেন, যদি অভ্যন্তরীণ বিভাজন বাড়ে, তাহলে আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে।
তবে তরুণ সমাজের মধ্যে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি এখনো প্রবল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন,
“আমরা আন্দোলনের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলোর সঙ্গে একমত। কিন্তু আন্দোলনের নামে কেউ যদি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। সালাহউদ্দিন আহমেদ হয়তো সেটাই বলতে চেয়েছেন।”
বর্তমানে বাংলাদেশ এক রাজনৈতিক সঙ্কটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ—তিন পক্ষের সম্পর্ক অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ।
এই প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দিন আহমেদের মন্তব্য ও তার অপব্যাখ্যা, দুটোই আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপক্বতা যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মতভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই মতভিন্নতাকে বিকৃত করে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা রাজনৈতিক অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে।