রামগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরব এনসিপি
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলা যেন আবারও জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এখানকার রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তীব্র আলোচনা, প্রস্তুতি ও প্রত্যাশার জোয়ার। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে উঠে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে উপজেলার ৪নং ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত এক উঠান বৈঠক ও সমন্বয় সভায় এই তথ্য জানান তার ছোট ভাই মাহবুব আলম।
সভায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজসেবক, শিক্ষক, তরুণ উদ্যোক্তা এবং ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ। সমাবেশে মাহবুব আলম বলেন, আগামী দিনে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাইকে এনসিপির পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
মাহবুব আলম তার বক্তব্যে বলেন, গত ১৭ বছরে রামগঞ্জে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি স্বাস্থ্যখাতও ভেঙে পড়েছে। মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত।
তার মতে, রামগঞ্জের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক রূপান্তরের পর মানুষ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে, তাই তারা এখন নিজেদের দুর্দশা ও দাবি সরাসরি প্রকাশ করতে পারছে।
তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ বহুদিন ধরেই অবহেলিত। সরকারি বরাদ্দ পেলেও সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়নি। সড়কগুলো এখনো কাঁচা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব ভয়াবহ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানও ন্যূনতম পর্যায়ে।
মাহবুব আলম গর্বের সঙ্গে বলেন, রামগঞ্জ তথা ইছাপুর ইউনিয়নের মাটি থেকে উঠে এসেছে একজন উপদেষ্টা—মাহফুজ আলম। এটি আমাদের এলাকার জন্য বিশাল সম্মানের বিষয়।
তিনি বলেন, আমাদের ভাই ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম রামগঞ্জের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ। তিনি ক্ষমতায় থেকেও সবসময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। রামগঞ্জের সড়ক উন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য তার আন্তরিক ভূমিকা রয়েছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত জনতা “মাহফুজ আলমকে রামগঞ্জের ভবিষ্যৎ নেতা” বলে স্লোগান দেন। অনেকেই তার সম্ভাব্য প্রার্থিতা স্বাগত জানান।
সভায় মাহবুব আলম বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশে পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কবর রচিত হয়েছে। প্রতিহিংসা, দলীয় নিয়োগ, প্রশাসনিক অন্যায়—সব কিছুই অতীত হতে চলেছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা এমন এক নতুন রাজনীতি গড়তে চাই যেখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন হবে না, এবং জনগণের স্বার্থই হবে রাজনীতির মূল বিষয়।
এনসিপির লক্ষ্য হবে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে ন্যায়, সমতা, এবং স্বচ্ছতা থাকবে—বলেছেন মাহবুব আলম।
মাহবুব আলম তার বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে বলেন, আমাদের জাতীয় নাগরিক পার্টি এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চায় যেখানে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদক থাকবে না। দেশের প্রতিটি নাগরিক যাতে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, সেটিই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।
তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশে আহ্বান জানান, আপনারা সবাই এনসিপিতে যোগ দিন। এটি জনগণের দল, যারা দেশের স্বার্থে রাজনীতি করে, ব্যক্তিস্বার্থে নয়।
এ সময় বক্তব্য রাখেন এনসিপির রামগঞ্জ উপজেলা আহ্বায়ক মাসুম বিল্লাহ, যুগ্ম সদস্য সচিব মাহমুদুন নবী টিটু, ইসলামী আন্দোলনের ইউনিয়ন সভাপতি ডা. ইসমাইল, ছাত্র প্রতিনিধি ইসমাইল রাফি এবং তরুণ সংগঠক নাইম সালেহীন।
তারা বলেন, রামগঞ্জে এনসিপির সাংগঠনিক কার্যক্রম দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দল গঠনের কাজ প্রায় সম্পন্ন। আগামী নির্বাচনেই আমরা এই শক্তিকে নির্বাচনী মাঠে দেখতে পাব।
তারা আরও জানান, দলের মূল ভিত্তি হবে তরুণ প্রজন্ম। নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে এনসিপি স্থানীয় কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করছে।
স্থানীয় জনগণ মনে করছেন, দীর্ঘদিন ধরে রামগঞ্জ রাজনীতিতে যেসব দল পালাক্রমে ক্ষমতায় থেকেছে, তারা এলাকার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে।
একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেন, আমাদের স্কুলে এখনো পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। রাস্তাঘাটে কাদা আর ধুলায় ভরা। বাজারে যানবাহনের চাপ, ড্রেনের দুর্গন্ধ—এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। নতুন প্রজন্ম এখন পরিবর্তন চায়।
একজন তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, মাহফুজ আলমের মতো শিক্ষিত ও সচেতন রাজনীতিক যদি নির্বাচনে আসেন, তাহলে রামগঞ্জে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাহফুজ আলম যদি সত্যিই প্রার্থী হন, তাহলে এটি রামগঞ্জ আসনে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং গণমুখী ভাবমূর্তি স্থানীয় জনগণের কাছে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে তার অংশগ্রহণ এনসিপিকে আরও শক্তিশালী করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
দলের নেতারা জানিয়েছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এনসিপির পক্ষ থেকে প্রতিটি আসনে যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
রামগঞ্জ আসনকে অগ্রাধিকারভুক্ত হিসেবে ধরা হয়েছে। এখানে দলীয় প্রার্থীর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে যুক্ত করার পাশাপাশি, স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাও ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
রামগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আধিপত্য থাকলেও, এখন তৃতীয় শক্তি হিসেবে এনসিপি দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে। তরুণ ভোটারদের মধ্যে দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মানুষ এখন বিকল্প রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে। এই প্রেক্ষাপটে মাহফুজ আলমের সম্ভাব্য প্রার্থিতা এনসিপিকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে।
মাহবুব আলম বলেন, আমরা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখি না, এটি আমাদের দায়িত্ব ও সেবা। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
তিনি আরও বলেন, রামগঞ্জের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে আমরা তাদের কথা শুনব। তাদের স্বপ্ন, সমস্যা, এবং উন্নয়নের রূপরেখা আমরা একত্রে তৈরি করব। রাজনীতি তখনই সফল হবে, যখন জনগণ এতে অংশগ্রহণ করবে।
উঠান বৈঠক শেষে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাহবুব আলমকে ঘিরে ধরেন। অনেকে বলেন, দীর্ঘদিন পর এমন একজন নেতা পেলাম, যিনি সরাসরি মানুষের কষ্টের কথা বলছেন।
একজন কৃষক বলেন, আগে কেউ আমাদের জমির সমস্যার কথা শুনত না। এখন শুনছি এনসিপির নেতারা মাঠে আসছেন। তারা যদি সত্যিই কাজ করে, আমরা তাদেরই ভোট দেব।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি যতই ঘনিয়ে আসছে, রামগঞ্জের রাজনীতি ততই উত্তপ্ত ও আলোচিত হয়ে উঠছে। মাহফুজ আলমের সম্ভাব্য প্রার্থিতা এবং এনসিপির সাংগঠনিক তৎপরতা স্থানীয় জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
রাজনীতির প্রতিহিংসা নয়, উন্নয়ন ও মানবিক মূল্যবোধের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখন রামগঞ্জবাসীর। তারা অপেক্ষায় আছেন—কে সেই নেতা হবেন, যিনি বাস্তবে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবেন।