“আমরা এই সনদ মানি না”— সংসদ ভবনের সামনে উত্তাল প্রতিবাদ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আয়োজনে যখন রাজনৈতিক দলগুলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ স্বাক্ষর করে এক ঐতিহাসিক দিন তৈরি করছিল, তখন তার বাইরে ঘটছিল এক ভিন্ন দৃশ্য। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে ‘জুলাইযোদ্ধা’ নামে পরিচিত আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাদের দাবি, এই সনদ জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয় বরং এটি আহত ও পঙ্গু জুলাইযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন করে তৈরি করা একটি “ভারত-নির্দেশিত দলিল”।
বিক্ষোভকারীরা বলেন, “এই সনদ আমরা মানি না। কারণ, এটি আমাদের ত্যাগ ও রক্তের প্রতি অবমাননা।” তারা দাবি করেন, জুলাই আন্দোলনের সময় আহতদের এখনো যথাযথ স্বীকৃতি ও পুনর্বাসন দেওয়া হয়নি, বরং “রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা” এই সনদের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করছে।
শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করে। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শতাধিক জুলাইযোদ্ধা মিছিল নিয়ে প্লাজার সামনে অবস্থান নেন।
তারা হঠাৎ সংসদ ভবনের মূল ফটকের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বাধা দেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে জুলাইযোদ্ধারা সংসদ চত্বরে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ জলকামান ও লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
বিক্ষোভকারীদের একজন, জুলাই আন্দোলনের সময় আহত সংগঠক ইয়াসিন নূর বলেন, “জুলাইয়ে যারা লড়েছিল, তাদের রক্তের ওপর ভর করে আজ যারা এই সনদ স্বাক্ষর করছে, তারা ইতিহাসের বিশ্বাসঘাতক।”
তিনি আরও বলেন, “এই সনদ সরকারের তৈরি প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী হয়েছে। এতে আহতদের জন্য কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। সরকার আমাদের ক্ষতিপূরণ দেয়নি, চাকরির প্রতিশ্রুতি রাখেনি, অথচ আমাদের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক সমঝোতার নাটক করছে।”
আরেক বিক্ষোভকারী, পঙ্গু যোদ্ধা আশরাফুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আজ যেভাবে আমাদের অবজ্ঞা করা হচ্ছে, তা জাতির জন্য লজ্জাজনক।”
শুক্রবার দুপুরে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সময় থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়। বিক্ষুব্ধ জুলাইযোদ্ধারা দক্ষিণ প্লাজার মঞ্চের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন— “জুলাই সনদ মানি না, রক্তের বদলা নেবই।”
সেসময় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কয়েকজন বিক্ষোভকারী মঞ্চে ঢোকার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটকে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
এই সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন বিক্ষোভকারী আহত হন। পরে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
জুলাইযোদ্ধারা অভিযোগ করেন, এই সনদ ভারতের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে। তাদের দাবি, “আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পথ তৈরি করতেই এই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে।”
প্রতিবাদকারীরা বলেন, “জুলাই আন্দোলনের সময় যারা রাস্তায় প্রাণ দিয়েছে, আজ তাদের নাম নেই কোথাও। অথচ যারা তখন ক্ষমতার পেছনে ছিল, তারাই এখন নতুন চুক্তির স্বাক্ষরকারী।”
ইয়াসিন নূর বলেন, “এই সনদের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা খুঁজছে। কিন্তু আমরা যারা আহত, পঙ্গু, অথবা প্রিয়জন হারিয়েছি, আমাদের কথা কেউ শুনছে না। এই সনদ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন, স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন দুপুরে তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ বিনা উস্কানিতে হামলা চালায়। তাতে অন্তত ৩০ জন আহত হন।
এক বিক্ষোভকারীর ভাষায়, “যখন মঞ্চে রাজনৈতিক নেতারা হাসিমুখে কলম ধরছেন, তখন আমাদের ওপর পড়ছে লাঠি আর বুলেট। এটা কেমন ঐকমত্য?”
বিক্ষোভকারীরা ‘আহত জুলাইযোদ্ধাদের ওপর হামলার বিচার’ দাবি করেন এবং ‘নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন’ গঠনের আহ্বান জানান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমরান সোবহান বলেন, “একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিনের বিরোধিতা পেরিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনের মূল অংশগ্রহণকারীদের একাংশের ক্ষোভ নতুন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি আহত বা পঙ্গু যোদ্ধাদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষিত হয়, তবে এই সনদের বাস্তবায়ন প্রশ্নের মুখে পড়বে। সরকারের উচিত দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সমঝোতা তৈরি করা।”
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জুলাইযোদ্ধাদের আন্দোলন আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। তাদের অনেক দাবিই যৌক্তিক। তবে এই সনদ রাষ্ট্রীয় ঐকমত্যের দলিল, এটি বাতিল করা সম্ভব নয়। আমরা আহতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে নতুন একটি নীতি প্রণয়ন করছি।”
তবে জুলাইযোদ্ধা সংগঠনের নেতা ইয়াসিন নূর বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব ফল চাই। আমাদের সঙ্গীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এখন কাগজে বন্দি হয়ে গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার বলেন, “জুলাইযোদ্ধাদের মিছিল শান্তিপূর্ণভাবে সংসদ ভবনের সামনে অবস্থান নিলে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু তারা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, “২০ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে।”
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে সংসদ ভবনের সামনের সড়কে এখনো শতাধিক জুলাইযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। তারা মোমবাতি জ্বেলে নিহত ও আহত সঙ্গীদের স্মরণ করেন
এক তরুণ যোদ্ধা, নাম লিমন ইসলাম বলেন, “আমরা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজপথে জীবন দিয়েছি গণতন্ত্রের জন্য। আজ যারা সেই সংগ্রামের স্মৃতি বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব।”
তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন—
“রক্তের দামে কেনা গণতন্ত্র বিক্রি হবে না!”
“জুলাই সনদ মানি না, জালিমদের ক্ষমা নেই!”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “জুলাইযোদ্ধাদের দাবি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখব। তারা এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। তাদের অনুভূতিকে অবমূল্যায়ন করার কোনো প্রশ্নই আসে না।”
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা আশরাফ আলী আকন বলেন, “সনদটি কারও ক্ষতি করার জন্য নয়। এটি গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের অঙ্গীকার। তবে যদি আহতদের দাবি থেকে থাকে, সরকার অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়াবে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষরকে ঘিরে এই বিক্ষোভ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অনিবার্য বাস্তবতা। একদিকে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের অঙ্গীকার, অন্যদিকে অবহেলিত সংগ্রামীদের ক্রোধ—এই দুই ধারাই বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন দিকের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ড. মাহবুব হাসান বলেন, “জুলাই সনদ যদি আহতদের স্বীকৃতি ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি না দেয়, তবে সেটি কখনোই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার ও দলগুলোর উচিত দ্রুত তাদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা।”
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় যখন রাজনৈতিক দলগুলো কলম ধরেছিল ঐক্যের অঙ্গীকারে, তখন বাইরে রক্তাক্ত ইতিহাসের সন্তানরা দাঁড়িয়ে ছিল অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতিবাদে।
জুলাইযোদ্ধাদের চোখে আজকের সনদ কেবল এক কাগজ নয়—এটি তাদের ত্যাগ, তাদের রক্ত ও তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি এক ধরনের অবমাননা।
তারা যে আন্দোলন শুরু করেছে, তা কেবল একটি সনদ বাতিলের দাবি নয়, বরং ইতিহাসে তাদের স্থান পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে—যেখানে একদিকে ঐক্যের আহ্বান, অন্যদিকে ন্যায়ের দাবি। কোনটি জয়ী হবে, সেটিই নির্ধারণ করবে আগামীর রাজনৈতিক বাস্তবতা।