গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ২৫ রাজনৈতিক দলের সাত দফা অঙ্গীকার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। দিনটি দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে উঠেছে কারণ এই দিনেই ২৫টি রাজনৈতিক দল একযোগে স্বাক্ষর করল ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামের ঐতিহাসিক অঙ্গীকারনামায়।
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণঅভ্যুত্থান এবং পরিবর্তনের দাবিতে জর্জরিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সনদটিকে অনেকেই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র বিনির্মাণের নতুন নীলনকশা হিসেবে দেখছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রায় সব শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জনগণের অধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা সাত দফা অঙ্গীকারে সই করেন, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রূপরেখা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিচ্ছে।
অঙ্গীকারনামায় বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। হাজারো মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তদানের বিনিময়ে জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ তারই ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছে।
সনদে বলা হয়, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক এবং তাদের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ আইন। তাই রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটিয়ে এই সনদ গ্রহণ করেছে। এটি ভবিষ্যতে সংবিধানে তফসিল হিসেবে যুক্ত করা হবে, যাতে এই সনদের আইনগত ভিত্তি অটুট থাকে।
স্বাক্ষরিত অঙ্গীকারনামায় সাতটি মূল প্রতিশ্রুতি উঠে এসেছে, যা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো, বিচারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।
১. গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের অধিকার সংরক্ষণ:
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের ত্যাগের মর্যাদা রক্ষা করে জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা হবে।
২. সংবিধানে জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্তি:
এই সনদকে জাতীয় ঐকমত্যের দলিল হিসেবে সংবিধানে তফসিল আকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের আইন কাঠামোতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।
৩. আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা:
কোনো আদালতে জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বরং প্রতিটি বাস্তবায়ন পর্যায়ে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
৪. গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি:
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানসহ দীর্ঘ ১৬ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৫. গুম-খুন ও নির্যাতনের বিচার:
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় যারা গুম, খুন বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের বিচার ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হবে। শহীদ পরিবারগুলো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাবে।
৬. রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার:
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।
৭. অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্ত কার্যকর:
যেসব সিদ্ধান্ত এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো বিলম্ব ছাড়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাস্তবায়ন করবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেশের ইতিহাসে বিরল এক রাজনৈতিক ঐক্যের চিত্র দেখা যায়।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলনসহ ২৫টি দল এই সনদে সই করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এত বিস্তৃত রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ভর্তি ছিল রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পর শুরু হয় “জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণ” পর্ব। উপস্থিত সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিএনপির পক্ষে স্বাক্ষর করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি,
এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), সিপিবি ও বাসদসহ চারটি বামপন্থি দল এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,
“আজকের এই সনদ শুধু কাগজ নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নকশা। আমরা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন,
“গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে সবাইকে এক কাতারে আসতে হবে। জুলাই সনদ সেই ঐক্যের প্রতীক।”
নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন,
“জুলাই অভ্যুত্থান ছিল জনগণের বিপ্লব। সেই বিপ্লবকে সংবিধানের ভাষায় রূপ দিতে আজকের এই সনদ।”
গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন,
“এই সনদ গণতন্ত্র, ন্যায় ও স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি। রাষ্ট্রকে নাগরিকের মালিকানায় ফিরিয়ে আনতে এটি এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।”
২০২৪ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন সরকারের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশে শুরু হয় গণবিক্ষোভ।
অল্প সময়ের মধ্যেই এই বিক্ষোভ রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে, যেখানে হাজারো মানুষ শহীদ হন।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি দমন-পীড়ন, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে।
তবে জনগণের অদম্য শক্তি ও ঐক্যের কারণে সেই আন্দোলন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের সাফল্যের পর থেকেই একটি জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক সনদের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ সেই চাহিদার প্রতিফলন, যা এখন রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ভিত্তি হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সনদ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও জবাবদিহির নতুন ধারা সূচনা করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দিন বলেন,
“জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা নয়, এটি একটি সামাজিক চুক্তি। এর মাধ্যমে জনগণ নতুন আস্থা ফিরে পাবে।”
অন্যদিকে, সিনিয়র সাংবাদিক আনিসুল হক মন্তব্য করেন,
“বাংলাদেশে বহুবার ঐকমত্যের চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু জুলাই সনদ প্রথমবারের মতো বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে দৃশ্যমান।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে জানানো হয়েছে, সনদে অন্তর্ভুক্ত বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত কার্যকর করা হবে।
প্রথম ধাপে প্রশাসনিক সংস্কার, দুর্নীতি দমন, এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।
এ ছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছতা আনার জন্যও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া চারটি বামপন্থি দল জানায়, তারা সনদের কিছু ধারার ভাষাগত ও রাজনৈতিক দিক নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।
তবে তারা ভবিষ্যতে ঐকমত্য প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে আগ্রহী।
এনসিপি পক্ষ থেকে জানানো হয়, “আমরা সনদের কিছু দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন মনে করি। তবে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাই।”
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ এই সনদকে স্বাগত জানিয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে “#জুলাইসনদ২০২৫” ট্রেন্ড করছে।
অনেকেই বলছেন, “এটাই হতে পারে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক মুক্তির দলিল।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি হলে বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই সনদে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে স্বাগত জানিয়েছে।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলফলক।
এই সনদে স্বাক্ষর শুধু দলীয় প্রতিশ্রুতি নয়—এটি জনগণের সংগ্রাম, ত্যাগ ও আশার প্রতীক।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের যে অঙ্গীকার শুক্রবার জাতীয় সংসদ চত্বরে উচ্চারিত হয়েছে,
তা এক নতুন ভোরের সূচনা বার্তা দিচ্ছে।
যেমনটি এক বিশ্লেষক বলেছেন,
“জুলাই সনদ ২০২৫ কেবল একটি রাজনৈতিক দলিল নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জন্মের ঘোষণা।”