রংপুরে নির্বাচনি পথে জামায়াত প্রার্থীর আবেগঘন বক্তব্যে আলোড়ন
রংপুর-২ (তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ) আসনের জনগণের উদ্দেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ও আসনের প্রার্থী এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেছেন, “আমি আপনাদের দোয়ায় ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছি। অনেক মা-বোন আমার মুক্তির জন্য রোজা রেখে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছেন। এজন্য আমি আপনাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমি যেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আপনাদের পাশে থেকে সেবা করতে পারি—এই দোয়া করবেন।”
বৃহস্পতিবার বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দলুয়া গ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন শাখা আয়োজিত এক পথসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এ কথা বলেন।
তার এই বক্তব্যে জনতার ভিড়ের মধ্যে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়। দীর্ঘদিন পর নির্বাচনি মাঠে ফিরে আসা জামায়াতের এই সিনিয়র নেতার এমন বক্তব্যে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলেও নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে।
এ টি এম আজহারুল ইসলাম দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। তিনি শুধু জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নন, রংপুর অঞ্চলের তৃণমূল রাজনীতিতেও তার প্রভাব সুস্পষ্ট।
দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও বন্দিদশা শেষে তিনি ফের রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে এসে বলেন, “আপনাদের দোয়ার ফলেই আমি আজ আবার আপনাদের মাঝে দাঁড়াতে পেরেছি। আপনারা আমার জন্য যেমন দোয়া করেছেন, আমি তেমনিভাবে আপনাদের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে চাই।”
তার এই বক্তব্যে উপস্থিত শত শত নেতাকর্মী ও সমর্থকরা “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি তুলে সভাস্থলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
বদরগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দলুয়া গ্রামে বিকেলে অনুষ্ঠিত পথসভায় স্থানীয় জনতার ঢল নামে। নারী-পুরুষ, তরুণ-প্রবীণ সবাই এ টি এম আজহারের বক্তব্য শোনার জন্য ভিড় করেন।
সভাস্থল ঘিরে ছিল ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনে সাজানো পরিবেশ। দলের স্থানীয় নেতারা আগে থেকেই প্রচারণা চালিয়ে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়ন আমির কাজী আব্দুল মাজুদ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা ভারপ্রাপ্ত আমির শাহ মুহাম্মদ রুস্তম, সেক্রেটারি মাওলানা মিনহাজুল ইসলামসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
সভায় এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “আওয়ামী শাসনামলে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। আমরা যদি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারি, তবে শিক্ষক সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।”
তিনি বলেন, “শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে। যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করেন, তাদের জীবনমান উন্নত না হলে দেশও উন্নত হবে না।”
তার বক্তব্যে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, “আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যেখানে শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক—সবাই ন্যায্য অধিকার পাবেন। কোনো শ্রেণির মানুষকে অবহেলা করা হবে না।”
এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হবে পরিবর্তনের নির্বাচন। জনগণ এখন আর ভয় পায় না। যারা দেশের সম্পদ লুট করে, জনগণকে দুঃখে ফেলেছে, তাদের বিদায় জানানোর সময় এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “জামায়াতে ইসলামী জনগণের দল। আমরা ভোটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন চাই। জনগণ যদি সুযোগ দেয়, আমরা ন্যায়, সততা ও কল্যাণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করব।”
তিনি বলেন, “আজ দেশের মানুষ চরম অর্থনৈতিক চাপে আছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে, কৃষক তাদের উৎপাদনের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। শ্রমিকরা মজুরি বঞ্চিত। আমরা এই অব্যবস্থা দূর করতে চাই।”
এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটে গেছে অন্যায়ের বিচার ও কষ্টের মাঝে। আমি যখন বন্দি ছিলাম, তখনও আপনাদের দোয়া আমার সঙ্গে ছিল। সেই দোয়ার বরকতেই আমি বেঁচে ফিরে এসেছি।”
তার এই বক্তব্যে উপস্থিত জনতার চোখে পানি চলে আসে। অনেকেই তাকে এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করেন।
তিনি বলেন, “আমি কারাগারে থেকেও সব সময় এই এলাকার মানুষের কথা ভেবেছি। আমার স্বপ্ন, বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জকে উন্নত, শিক্ষিত ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা।”
সভায় তিনি বলেন, “জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে দেশে উন্নয়ন হবে সমভাবে। শুধু রাজধানী নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। রংপুর বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার। আমরা এই বৈষম্য দূর করতে চাই।”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি ইউনিয়নে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হবে, যাতে তরুণদের বিদেশে পাড়ি জমাতে না হয়। কৃষকদের জন্য সহজ ঋণ, সার ও সেচের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।”
এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা চাই এই সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ফিরে আসুক। আজ মাদক, দুর্নীতি ও অবক্ষয় সমাজকে গ্রাস করছে। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “জামায়াতে ইসলামী এমন একটি সমাজ গড়তে চায়, যেখানে মানুষ হবে ন্যায়পরায়ণ, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও আল্লাহভীরু। রাজনীতি হবে জনগণের সেবার জন্য, ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়।”
উপজেলা ভারপ্রাপ্ত আমির শাহ মুহাম্মদ রুস্তম বলেন, “আজহার সাহেবের মুক্তি আমাদের দোয়ার ফসল। তিনি ফিরে এসেছেন জনগণের মাঝে। আসন্ন নির্বাচনে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জামায়াত প্রার্থীকে বিজয়ী করব।”
সেক্রেটারি মাওলানা মিনহাজুল ইসলাম বলেন, “যে মানুষ অন্যায়ের মুখে মাথা নত করেননি, তিনি আবার মাঠে নেমেছেন জনগণের কল্যাণে। আমরা তার পাশে আছি।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন স্থানীয় মুরুব্বি, শিক্ষক ও তরুণ নেতারা। তাদের সবার বক্তব্যে একটাই প্রতিধ্বনি—পরিবর্তন, ন্যায় ও সুশাসনের প্রত্যাশা।
সভা শেষে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন পর এলাকায় এমন বড় রাজনৈতিক সমাবেশ হয়েছে।
বদরগঞ্জের এক প্রবীণ নাগরিক বলেন, “আমরা দেখেছি, আজহার সাহেব সব সময় মানুষের পাশে থেকেছেন। তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, কিন্তু জনগণকে ভোলেননি।”
আরেক তরুণ বলেন, “আমরা পরিবর্তন চাই। এমন মানুষ চাই, যারা আমাদের কথা বলবে, শুধু প্রতিশ্রুতি দেবে না—কাজও করবে।”
রংপুর-২ আসনটি উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোর একটি। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান।
তবে এবারের নির্বাচন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ দীর্ঘদিন পর জামায়াত উন্মুক্তভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ টি এম আজহারুল ইসলামের মাঠে ফেরা জামায়াতের নির্বাচনি কৌশলে নতুন গতি আনবে।
সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “আমি কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাই না। আমি চাই জনগণের ভালোবাসায় দেশের পরিবর্তন আনতে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু ভোট নয়, জনগণের সেবা। আমি চাই আমার জীবনের শেষ সময়টুকু জনগণের পাশে থেকে ব্যয় করতে।”
রংপুরের বদরগঞ্জে এ টি এম আজহারুল ইসলামের এই পথসভা কেবল একটি নির্বাচনি আয়োজন নয়, বরং এটি ছিল তার রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক।
দীর্ঘ এক দশক পর জনগণের সামনে ফিরে এসে তার বক্তব্যে যে আবেগ, কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ ফুটে উঠেছে—তা উপস্থিত সবার হৃদয়ে দাগ কেটেছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই জনসমর্থন কতটা ভোটে রূপ নেবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত বলা যায়, রংপুরের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।