আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোটের নতুন অধ্যায় কি শুরু হচ্ছে?
বিশ্বরাজনীতির অঙ্গনে মধ্যপ্রাচ্য সব সময়ই এক স্পর্শকাতর ও কৌশলগত অঞ্চল। তেলসমৃদ্ধ এই ভূখণ্ডে প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক শক্তিগুলোর নীতিনির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক নতুন মোড় আনতে পারে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমস শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী নভেম্বরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই চুক্তি যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে তা শুধু দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়—বরং সমগ্র আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও কৌশলগত ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচ্য চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র–কাতার প্রতিরক্ষা চুক্তির মতোই কাঠামোতে গঠিত হতে পারে। সেই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কাতারের ওপর কোনো সামরিক হামলা হলে তা আমেরিকার ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করা হবে।
অর্থাৎ, সৌদি আরবও এক ধরনের “মিউচুয়াল ডিফেন্স গ্যারান্টি” পেতে যাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা ছাতার আওতায় রিয়াদকে সুরক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
একজন সাবেক মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় কিছু স্বাক্ষর হতে পারে বলে আলোচনা হয়েছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।”
সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই দুই দেশ তেল ও নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় যুক্ত রয়েছে।
১৯৪৫ সালে সৌদি রাজা আবদুল আজিজ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ঐতিহাসিক বৈঠকেই এই সম্পর্কের সূচনা হয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে আসছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক ওঠানামার মধ্যে ছিল। বিশেষ করে জামাল খাশোগজি হত্যাকাণ্ড, ইরান চুক্তি নিয়ে মতভেদ, এবং ওপেকের তেল উৎপাদন নীতির প্রভাব এই সম্পর্ককে অনেক সময় টানাপোড়েনে ফেলেছিল।
তবুও, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব প্রতিহত করতে এবং ইসরাইল–আরব সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া অগ্রসর করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সৌদি আরব এক অনিবার্য অংশীদার।
১. ইরানকে প্রতিরোধের লক্ষ্য
সৌদি আরবের এই প্রতিরক্ষা চুক্তি ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি, হিজবুল্লাহ ও হুথি বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন এবং আঞ্চলিক নীতি দিয়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন ব্লকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ছাতার নিচে এসে সৌদি আরব এই হুমকির বিরুদ্ধে আরও কার্যকর প্রতিরক্ষা জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে।
২. ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথ সুগম করা
বাইডেন প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি–ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পক্ষে কাজ করছে।
যদি প্রতিরক্ষা চুক্তিটি সই হয়, তাহলে সেটি হতে পারে এই কূটনৈতিক উদ্যোগের একটি অংশ, যেখানে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিনিময়ে সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথে আরও এক ধাপ এগোবে।
৩. চীনের প্রভাব মোকাবিলা
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব বেইজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গভীর করছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই প্রভাবকে সীমিত করতে রিয়াদের সঙ্গে নতুন নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে আগ্রহী।
কারণ, ওয়াশিংটনের কাছে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রবেশ মানে বৈশ্বিক কৌশলগত ভারসাম্যে আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়া।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে,
“সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আমাদের আঞ্চলিক কৌশলের একটি শক্তিশালী ভিত্তি। তবে সম্ভাব্য চুক্তির বিস্তারিত বিষয়ে আমরা এখনই মন্তব্য করতে পারছি না।”
হোয়াইট হাউস ও সৌদি সরকারের পক্ষ থেকেও এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি।
তবে কূটনৈতিক মহল বলছে, চুক্তিটি কেবল সামরিক বিষয় নয়—এতে পারমাণবিক জ্বালানি সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণ এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক ধারা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
গত মাসেই সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছে।
এছাড়া, রিয়াদ সম্প্রতি তুরস্ক, মিশর, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও সামরিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র উৎপাদন নিয়ে সমঝোতা করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধারাবাহিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সৌদি আরব একটি “মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট” নীতি অনুসরণ করছে—অর্থাৎ, কেবল যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর না থেকে একাধিক শক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তা কাতার মডেলের মতো হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক ভিন্ন।
কারণ, কাতার একটি তুলনামূলক ছোট দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ ঘাঁটিতে বিশাল সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।
কিন্তু সৌদি আরবের ক্ষেত্রটি অনেক বড় ও জটিল।
এখানে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি দিতে হলে কংগ্রেসীয় অনুমোদন, বাজেট বরাদ্দ এবং আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া—সব কিছু বিবেচনা করতে হবে।
ইরান এই আলোচনাকে উদ্বেগের চোখে দেখছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সম্প্রতি বলেন,
“আমেরিকার ছত্রছায়ায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা আসবে না, বরং নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে।”
ইসরাইল এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের ধারণা, সৌদি–যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি হলে তেলআবিব ও রিয়াদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে।
চীন ও রাশিয়া বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষত বেইজিং মনে করছে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কূটনৈতিক প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, চুক্তিটি কার্যকর হলে সৌদি আরব উন্নত মার্কিন অস্ত্র, মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সাইবার প্রযুক্তি পাওয়ার সুযোগ পাবে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে সামরিক পরামর্শক দল পাঠাতে পারে।
অন্যদিকে, ওয়াশিংটনের জন্য এটি হবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক উপস্থিতি পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ—যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের প্রভাব কিছুটা কমে গেছে।
সৌদি আরবের লাভ:
- যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা
- উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি পাওয়ার সুযোগ
- ইরান ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা জোরদার
যুক্তরাষ্ট্রের লাভ:
- মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব পুনরুদ্ধার
- চীন ও রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস
- ইসরাইল–সৌদি সম্পর্ক স্থাপনের পথ প্রশস্ত করা
তবে ঝুঁকিও কম নয়। যদি এই চুক্তিকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখে, তাহলে তা নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
সৌদি–যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি এখনো আলোচনার পর্যায়ে থাকলেও এর সম্ভাব্য প্রভাব ইতিমধ্যেই বিশ্লেষকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে তা শুধু রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সমীকরণ বদলে দিতে পারে।
বিশ্ব এখন দেখছে—নভেম্বরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরে এই চুক্তি কতদূর এগোয়, এবং সেটি সত্যিই কি নতুন এক “মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা যুগ” শুরু করতে যাচ্ছে, নাকি কেবল রাজনৈতিক কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতির আরেকটি প্রদর্শনী হয়ে থাকবে।চুক্তিকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখে, তাহলে তা নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
সৌদি–যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি এখনো আলোচনার পর্যায়ে থাকলেও এর সম্ভাব্য প্রভাব ইতিমধ্যেই বিশ্লেষকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে তা শুধু রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সমীকরণ বদলে দিতে পারে।
বিশ্ব এখন দেখছে—
নভেম্বরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরে এই চুক্তি কতদূর এগোয়,
এবং সেটি সত্যিই কি নতুন এক “মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা যুগ” শুরু করতে যাচ্ছে,
নাকি কেবল রাজনৈতিক কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতির আরেকটি প্রদর্শনী হয়ে থাকবে।