নদীপাড়ের মানুষ মশাল হাতে জেগেছে উন্নয়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের আকাশজুড়ে আজ নতুন এক শ্লোগানের প্রতিধ্বনি— “জাগো বাহে কোনঠে সবায়…!” তিস্তা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে যে কণ্ঠে এক সময় স্বাধীনতার আহ্বান উঠেছিল, আজ সেই কণ্ঠেই উচ্চারিত হচ্ছে উন্নয়ন, ন্যায্য অধিকার ও জীবনের দাবি।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে নদীপাড়ের পাঁচ জেলার মানুষ এখন এক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নেমেছে। প্রায় ১০০ কিলোমিটারজুড়ে তিস্তা নদীপাড়ে চলছে মশাল মিছিল, গাইছে প্রতিরোধের গান, আর দাবির সুরে উচ্চারিত হচ্ছে একটাই কথা—
“তিস্তা আমাদের বাঁচার নদী, এর ন্যায্য হিস্যা চাই।”
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় উন্নয়ন উদ্যোগ ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ মূলত নদীখাত পুনঃখনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা উন্নয়ন এবং কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর একটি সমন্বিত প্রকল্প।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষিনির্ভর পাঁচ জেলা—রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা—অর্থনৈতিকভাবে এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে বলে আশা করা হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রকল্পটি নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনার পরও এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। সরকার পর্যায়ে কিছু বক্তব্য এলেও মাঠপর্যায়ে কোনো কাজ শুরু হয়নি।
গত এক সপ্তাহ ধরে তিস্তা নদীর দুই পাড়জুড়ে দেখা যাচ্ছে এক অনন্য দৃশ্য—রাতে গ্রামের মানুষজন হাতে মশাল নিয়ে নদীর পাড়ে জড়ো হচ্ছেন।
মহিলারা, কৃষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্থানীয় ব্যবসায়ী—সবাই এই মিছিলে অংশ নিচ্ছেন।
মশালের আলোয় নদীর বুকজুড়ে জ্বলছে একটাই প্রতিশ্রুতি—তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।
রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার কৃষক মো. আজিজুল হক বলেন,
“তিস্তা এখন আর শুধু নদী না, আমাদের জীবনের প্রতীক। বর্ষায় সব ভেসে যায়, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে জমি শুকিয়ে ফেটে যায়। আমরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি শুনেছি বহুবার, কিন্তু বাস্তবে কিছুই পাইনি।”
তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি। নদীটি এক সময় ছিল সেচের প্রধান উৎস।
কিন্তু উজানের ভারতীয় অংশে বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে এখন নদীটির প্রবাহ ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
গ্রীষ্মকালে নদীটি প্রায় মৃত অবস্থায় পরিণত হয়, ফলে কৃষিজমিতে সেচ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জমি তিস্তানির্ভর। কিন্তু গত দশ বছরে এর প্রায় ৭০ শতাংশ জমি নিয়মিত সেচ না পাওয়ায় অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়েছে।
এ কারণে হাজার হাজার কৃষক ঋণে জর্জরিত, অনেকেই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি শুধু একটি নদী উন্নয়ন প্রকল্প থাকবে না; বরং এটি উত্তরবঙ্গের জন্য হবে এক সমন্বিত অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
সাথে সাথে মৎস্যসম্পদ, পরিবেশ সংরক্ষণ, পর্যটন এবং ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রেও নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জলসম্পদ বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন,
“তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এটি শুধু পানি ব্যবস্থাপনার সাফল্য নয়, বরং উত্তরবঙ্গের সামাজিক পুনর্গঠনের প্রতীক হয়ে উঠবে।”
উত্তরাঞ্চলের মানুষদের অভিযোগ, এত বড় একটি আন্দোলন চললেও জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখা যাচ্ছে না।
প্রধানধারার অনেক গণমাধ্যম এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে, যেন তিস্তা ইস্যুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বাইরে চলে গেছে।
রংপুরের সামাজিক কর্মী রুবেল হোসেন বলেন,
“আমরা কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে নেমিনি। এটা আমাদের জীবনের প্রশ্ন। কিন্তু মিডিয়া এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দিচ্ছে না—এটাই আমাদের সবচেয়ে কষ্টের জায়গা।”
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন তিস্তা ইস্যু নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে মশাল মিছিলের ভিডিও ও প্রতিবাদী গান।
তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি।
২০১১ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত হলেও, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা থেমে যায়।
এরপর থেকে বারবার আলোচনার প্রতিশ্রুতি এলেও বাস্তবে কোনো সমাধান আসেনি।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে,
“তিস্তা মহাপরিকল্পনা একটি জাতীয় অগ্রাধিকার। ভারতীয় সহায়তা না পেলেও বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে তা বাস্তবায়নের বিকল্প খুঁজছে।”
তবে স্থানীয় মানুষ এখন আর আশ্বাস নয়, বাস্তব অগ্রগতি দেখতে চান।
তিস্তা নদীপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, মানুষদের মুখে একই সুর—“আমরা আলো চাই, তিস্তার পানি চাই।”
রংপুরের কাকিনা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, নীলফামারীর জলঢাকা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা—সবখানেই চলছে একাত্মতার প্রকাশ।
মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলেন,
“আমাদের প্রজন্ম তিস্তার ইতিহাস জানে, কিন্তু এখন নদীটা দেখলে মনে হয় মৃত। আমরা চাই, নদী আবার বাঁচুক।”
এই মশাল মিছিল যেন প্রতীক হয়ে উঠেছে—নদী বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের।
বাংলাদেশের নদীবিদরা মনে করেন, তিস্তা কেবল উন্নয়ন নয়, এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের প্রশ্ন।
দীর্ঘদিন ধরে পানি সংকট চললে উত্তরাঞ্চলের জনজীবনে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এটি শুধু কৃষির ক্ষতি নয়, বরং অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণও হতে পারে।
পরিবেশ বিশ্লেষক ড. তাহমিনা শবনম বলেন,
“তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে উত্তরবঙ্গের মানুষের প্রতি এটা এক ঐতিহাসিক অন্যায় হবে। রাষ্ট্রকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিস্তা আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম রঞ্জন বলেছেন,
“যারা সত্যের পাশে নেই, যারা মানুষের কণ্ঠরোধ করে, তাদের মুখে আমরা থুথু দিচ্ছি। তিস্তা শুধু নদী না, এটা আমাদের সম্মানের প্রতীক।”
তার এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদের ভাষা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়।
চীনের আগ্রহ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের ঐক্য—সবকিছু একত্রিত হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
তবে দেরি হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। নদীর প্রবাহ আরও কমে গেলে এর পুনরুদ্ধার ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে
তিস্তা আন্দোলনের মশাল জ্বলে উঠেছে নূরলদীনের সেই ঐতিহাসিক আহ্বানের সুরে—
“জাগো বাহে কোনঠে সবায়…!”
এটি শুধু নদীর জন্য নয়, এটি বঞ্চিত মানুষের আত্মসম্মান, অধিকার ও স্বপ্নের প্রতীক।
বাংলাদেশের উত্তরের এই জাগরণ যদি দেশের কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিধ্বনি তোলে, তবে হয়তো একদিন সত্যিই বাস্তবায়িত হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা,
এবং নদীপাড়ের মানুষ তাদের বহুদিনের স্বপ্ন—
“জীবন ও নদীর পুনর্জন্ম”—অবশেষে দেখতে পাবে।