অবরোধ, রক্ত ও ধ্বংসযজ্ঞ পেরিয়ে প্রতিরোধের গৌরবময় সাফল্য
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে ফিলিস্তিন।
দীর্ঘ দশকের দখল, অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও গণহত্যার পর গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিজয় আজ শুধু একটি ভূ-রাজনৈতিক ঘটনার নাম নয়—এটি এক জাতির আত্মত্যাগ, অবিনাশী মনোবল এবং স্বাধীনতার প্রতি অদম্য বিশ্বাসের প্রতীক।
এই বিজয় প্রমাণ করেছে, আগ্রাসন যত দীর্ঘায়িত হোক, প্রতিরোধ কখনোই নিঃশেষ হয় না।
বিগত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক মিথ্যা ধারণায় পরিচালিত হয়েছে—ফিলিস্তিনে শান্তি কেবল “সংলাপ” ও “আলোচনার” মাধ্যমেই আসতে পারে।
‘শুধু আলোচনাই শান্তির পথ’—এই স্লোগান পশ্চিমা বিশ্ব, জাতিসংঘ, এমনকি আরব বিশ্বের অনেক অংশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
ওই আলোচনার প্রক্রিয়া ছিল মূলত ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষার একটি রাজনৈতিক কৌশল, যেখানে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধকে ধ্বংস করে তাদের আনুগত্যে বাধ্য করা হয়েছিল।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে “শান্তি” মানে ছিল এমন এক ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব, যারা সীমিত সীমানার ভেতর থেকে নিজেদের অধিকারের বিনিময়ে দখলদারদের সঙ্গে বসবে।
তাদের সংলাপ কেবল তখনই বৈধ হতো, যখন ফিলিস্তিনিরা সশস্ত্র প্রতিরোধ ত্যাগ করবে এবং ইসরায়েলের কথিত ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে অস্তিত্ব স্বীকার করবে।
এই প্রক্রিয়ায় ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি ছিল এক ঐতিহাসিক প্রতারণা—যেখানে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিয়েও কোনো বাস্তব স্বাধীনতা পায়নি।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) সৃষ্টি হয়, কিন্তু তা পরিণত হয় এক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায়, যা দখলদার ইসরায়েলের জন্যই কাজ করত।
অসলো-পরবর্তী বছরগুলোতে ইসরায়েল গাজার ওপর এক ভয়াবহ মানবিক অবরোধ আরোপ করে।
একদিকে তারা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বাড়াতে থাকে, অন্যদিকে গাজায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে হাজারো নারী-শিশু হত্যা করে।
এই সময়ই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের একমাত্র দুর্গ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় গাজা উপত্যকা।
গাজার প্রতিটি গলি, প্রতিটি বাড়ি পরিণত হয় সংগ্রামের প্রতীক।
অবরোধ, ক্ষুধা, বিদ্যুৎ সংকট—কিছুই ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভাঙতে পারেনি।
২০০৫ সালে ইসরায়েল তথাকথিত “পুনর্বিন্যাস” ঘোষণা করে গাজার অভ্যন্তর থেকে সেনা সরালেও বাস্তবে তারা গাজাকে ঘিরে একটি বিশাল কারাগারে পরিণত করে।
এরপর ২০০৬ সালে হামাসের নির্বাচনী বিজয় ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের আতঙ্কিত করে তোলে।
কারণ, এই বিজয় ছিল প্রতিরোধের রাজনীতির জাগরণ।
২০০৬ সালের ফিলিস্তিনি আইন পরিষদের নির্বাচনে হামাসের অভাবনীয় জয় ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছিল, তারা আর ইসরায়েলপন্থী প্রশাসনের অধীনে থাকতে চায় না।
কিন্তু এই গণতান্ত্রিক ফলাফলকে অগ্রাহ্য করে ইসরায়েল গাজার ওপর পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে।
ফলে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় ইসরায়েলের হাতে।
তবু গাজা আত্মসমর্পণ করেনি।
২০০৮ সাল থেকে একের পর এক সামরিক হামলা, বিমান আক্রমণ, হত্যা অভিযান—সবই মোকাবিলা করেছে প্রতিরোধ বাহিনী।
গাজার জনগণ ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও নতুন করে ঘর তুলেছে, অবিস্ফোরিত গোলার ধাতু দিয়ে তৈরি করেছে নিজেদের অস্ত্র।
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র প্রতিরোধের শেকড় ১৯৫০-এর দশকে গাজা থেকেই গড়ে উঠেছিল ফেদায়িন আন্দোলনের মাধ্যমে।
পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক ও ইসলামি প্রতিরোধ সংগঠনগুলো এই ধারাকে অব্যাহত রাখে।
এই দীর্ঘ সংগ্রামের ফলেই গাজা হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধের প্রতীক—যেখানে প্রতিটি হামলা নতুন প্রজন্মের যুদ্ধজয়ের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে চালানো হয় ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামের এক অভূতপূর্ব অভিযান।
এটি কেবল একটি সামরিক আক্রমণ ছিল না—এটি ছিল এক জাতির অস্তিত্বের ঘোষণা।
দীর্ঘ অবরোধ ও দমননীতির পর গাজা জানিয়ে দেয়:
“আমরা কেবল ভুক্তভোগী নই, আমরা প্রতিরোধের প্রতীক।”
এই অভিযানে ইসরায়েলের বহু সামরিক ঘাঁটি ও কৌশলগত স্থাপনা ধ্বংস হয়, শত শত সৈন্য নিহত ও বন্দি হয়।
বিশ্ব হতবাক হয়ে দেখে, কিভাবে এক অবরুদ্ধ অঞ্চল এত সামরিক শক্তি অর্জন করতে পারে।
এই আঘাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইসরায়েল গাজার ওপর চালায় মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা।
দুই বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার বোমা বর্ষণ করা হয়, স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী ক্যাম্প ধ্বংস করা হয়।
বিশ্বের চোখে প্রকাশ পায় ইসরায়েলের প্রকৃত চরিত্র—একটি রাষ্ট্রযন্ত্র, যা নিজেদের নিরাপত্তার নামে জাতিগত নিধন চালায়।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবাদেও কোনো কাজ হয়নি।
তবু ফিলিস্তিনিরা হাল ছাড়েনি।
ধ্বংসের মধ্যেও তারা লড়েছে, নতুন অস্ত্র তৈরি করেছে, নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছে।
আজ গাজায় বিজয়ের যে পতাকা উড়ছে, তা কেবল একটি যুদ্ধজয়ের প্রতীক নয়—এটি অস্তিত্ব রক্ষার সাফল্য।
ইসরায়েল গাজায় তার কোনো কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হলেও, ফিলিস্তিনিদের মনোবল অটুট থেকেছে।
প্রতিরোধ বাহিনী ২০০০-এর বেশি ইসরায়েলি সামরিক যান ধ্বংস করেছে—যার মধ্যে শত শত আধুনিক মেরকাভা ট্যাংকও ছিল।
বিশ্বের ইতিহাসে এমন কোনো আরব সেনাবাহিনীও ইসরায়েলকে এত বড় সামরিক ক্ষতি করতে পারেনি।
এই বিজয় শুধু গাজার নয়—এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করে দিয়েছে।
হিজবুল্লাহ (লেবানন), আনসারাল্লাহ (ইয়েমেন) এবং ইরানের মতো শক্তিগুলো গাজার প্রতিরোধকে সমর্থন দিয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে।
এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের আরব মিত্রদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।
কারণ, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ এখন শুধু ইসরায়েল নয়, বরং সব স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার জন্য এক হুমকি।
আরব জনগণ আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধভাবে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
কায়রো, রিয়াদ, আম্মান, কুয়েত—সবখানে রাস্তায় নেমে এসেছে মানুষ, যারা বলছে:
“গাজার সংগ্রাম মানে আমাদের সংগ্রাম।”
যদিও অনেক আরব সরকার এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ নীতিতে অটল, জনগণের প্রতিবাদ দেখিয়ে দিয়েছে—শাসকরা ভিন্ন, কিন্তু জাতির হৃদয় এখনো ফিলিস্তিনের সঙ্গে।
এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি সমাজেও দেখা দিয়েছে বিভাজন।
সরকারের ব্যর্থতা, গোয়েন্দা ত্রুটি এবং সামরিক ক্ষতির কারণে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা তলানিতে।
বিক্ষোভে উত্তাল তেল আবিব—যেখানে সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন তুলছে,
“এই যুদ্ধ কাকে রক্ষা করছে—আমাদের, নাকি দখলদার নীতিকে?”
গাজার এই বিজয় ভবিষ্যতের জন্য এক অনুপ্রেরণার বার্তা।
প্রমাণ হয়েছে, প্রতিরোধ কখনোই বৃথা যায় না।
যে জাতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে জানে, তাকে দখলদারিত্ব দমিয়ে রাখতে পারে না।
ফিলিস্তিনিদের এই সাফল্য বিশ্বজুড়ে মুক্তি আন্দোলনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।
যেখানেই নিপীড়ন, অন্যায় ও দখল আছে—সেখানেই গাজার আত্মত্যাগ প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
শেষ পর্যন্ত গাজায় ফিলিস্তিনিরাই জয়ী হয়েছে।
এই বিজয় কেবল এক যুদ্ধের নয়, এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্জাগরণ।
ইসরায়েলের দমননীতি, মার্কিন মদত বা আন্তর্জাতিক দ্বৈত মানদণ্ড—কোনোটিই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার শিখা নিভিয়ে দিতে পারেনি।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও যে শিশুটি “আল্লাহু আকবার” বলে হাসে, সেই শিশুর মধ্যেই ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনের জয় লুকিয়ে আছে।
এই বিজয় স্মরণ করিয়ে দেয়—
“অত্যাচার যত বড়ই হোক, ন্যায় ও প্রতিরোধের শক্তি তার চেয়ে বড়।”