যাত্রীদের সুবিধার্থে উত্তরা-উত্তর ও মতিঝিল প্রান্তে বাড়ানো হলো এক ঘণ্টা সময়
রাজধানীবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত যাতায়াত মাধ্যম মেট্রোরেল এবার আরও বেশি সময় যাত্রী সেবা দেবে। যাত্রীদের চলাচলের সুবিধা বাড়াতে আগামী রোববার (১৯ অক্টোবর) থেকে উত্তরা উত্তর প্রান্ত ও মতিঝিল প্রান্তে মেট্রোরেল চলাচলের সময় এক ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন তরফদার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
ডিএমটিসিএল জানায়, তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ধাপে ধাপে যাত্রীসেবা বাড়ানো হচ্ছে। এই সময়সূচির পরিবর্তন যাত্রীদের জন্য আরও সহজ, দ্রুত ও আরামদায়ক চলাচলের সুযোগ তৈরি করবে।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিলগামী প্রথম মেট্রো ট্রেন এখন থেকে সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে যাবে, যা আগে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ছাড়ত। অর্থাৎ, এখন থেকে যাত্রীরা ৪০ মিনিট আগেই মেট্রোরেল সেবা নিতে পারবেন।
এছাড়া, শেষ ট্রেনের সময়ও পিছিয়েছে। আগে যেখানে উত্তরা উত্তর থেকে শেষ ট্রেন ছেড়ে যেত রাত ৯টায়, এখন তা ছাড়বে রাত সাড়ে ৯টায়।
অন্যদিকে, মতিঝিল থেকে উত্তরা অভিমুখে দিনের প্রথম ট্রেন আগে ছাড়ত সকাল সাড়ে ৭টায়, এখন ছাড়বে সকাল সোয়া ৭টায়। সর্বশেষ ট্রেন আগে ছাড়ত রাত সাড়ে ৯টায়, এখন তা ছাড়বে রাত ১০টা ১০ মিনিটে।
এই পরিবর্তনের ফলে অফিসগামী, ব্যবসায়ী এবং রাতের কর্মজীবী যাত্রীরা আরও দীর্ঘ সময় পাবেন দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য যাতায়াতের সুবিধা।
ডিএমটিসিএল নিশ্চিত করেছে, শুক্রবারে (সাপ্তাহিক ছুটির দিনে) মেট্রোরেলের চলাচলের সময়সূচি অপরিবর্তিত থাকবে।
এই দিন উত্তরা থেকে মতিঝিল অভিমুখে প্রথম ট্রেন ছাড়ে বিকেল ৩টায় এবং শেষ ট্রেন ছাড়ে রাত ৯টায়।
মতিঝিল থেকে উত্তরা অভিমুখে প্রথম ট্রেন ছাড়ে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে এবং শেষ ট্রেন ছেড়ে যায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে।
অর্থাৎ, শুক্রবার এখনো সীমিত পরিসরে ট্রেন চলবে—যেমনটি এর আগে চালু ছিল।
রাজধানী ঢাকার অন্যতম বড় সমস্যা হলো যানজট। অফিস সময়ের ভিড়, যানবাহনের চাপ এবং সড়ক দুর্ঘটনা—সব মিলিয়ে প্রতিদিন কর্মজীবী মানুষদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
মেট্রোরেল চালুর পর থেকে সেই ভোগান্তি অনেকাংশে কমেছে। তবে অনেক যাত্রী অভিযোগ করছিলেন যে,
- সকালে মেট্রোরেল চালু হতে দেরি হয়, ফলে অফিসগামীদের সুবিধা হয় না।
- রাতের শেষ ট্রেনের সময়ও তুলনামূলকভাবে আগেই শেষ হয়, ফলে যারা দেরিতে অফিস শেষ করেন বা ব্যবসায়িক কাজ করেন, তারা এই সেবা নিতে পারেন না।
এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সময় বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। এবার সেই দাবি পূরণ করল ডিএমটিসিএল।
একজন নিয়মিত যাত্রী বলেন,
“আগে সকাল ৭টার আগে ট্রেন ধরতে না পারলে অফিসে দেরি হয়ে যেত। এখন ৬টা ৩০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ায় আমরা অনেক আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব।”
আরেকজন যাত্রী, যিনি রাতের শিফটে কাজ করেন, বলেন,
“রাত ১০টার পরও যদি ট্রেন চলে, তাহলে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এতে সময় ও খরচ দুটোই বাঁচবে।”
মেট্রোরেল চালুর পর থেকে যাত্রী সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ডিএমটিসিএলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই দৈনিক গড়ে ১ লাখ ২৫ হাজারের বেশি যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করেছেন।
প্রতিদিন সকাল-বিকেল পিক আওয়ারে ট্রেনের চাপ বাড়ে। সময়সূচি বাড়ানোর ফলে এই চাপও কিছুটা ভারসাম্য পাবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মোফাজ্জল হোসেন বলেন,
“মেট্রোরেল সময় বৃদ্ধি শুধু যাত্রীদের সুবিধা নয়, এটি নগর ব্যবস্থাপনার উন্নতিরও অংশ। এতে ঢাকার ট্রাফিক চাপ কিছুটা কমবে।”
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র সময় বাড়ানো নয়; বরং যাত্রীসেবাকে আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করা।
আগামী বছরে মেট্রোরেলের স্মার্ট টিকেটিং, স্বয়ংক্রিয় সময়সূচি আপডেট ও রিয়েল-টাইম ট্রেন ট্র্যাকিং সেবা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া ২০২৬ সালের মধ্যে পুরো রুটে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন হলে সেবা আরও বৃদ্ধি পাবে।
মতিঝিল, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, পল্টন ও গুলিস্তান এলাকাগুলোতে অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ঘনবসতিপূর্ণ। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই এলাকায় কর্মস্থলে যান।
আগে সকালে মেট্রোরেল কম সময় চালু থাকায় অনেক অফিসগামীকে অন্য যানবাহন ব্যবহার করতে হতো। এখন তারা সরাসরি মেট্রোরেলে উঠতে পারবেন।
এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা সকাল ৮টার মধ্যে অফিসে পৌঁছাই। আগে মেট্রোরেল ধরতে পারতাম না, এখন পারব। এটি আমাদের জন্য দারুণ সুবিধা।”
উত্তরা উত্তর, পল্লবী, মিরপুর ও কাজীপাড়া অঞ্চল থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ মেট্রোরেলে চড়ে মতিঝিল যান।
উত্তরা প্রান্তে নতুন সময়সূচি কার্যকর হলে অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক যাত্রীরা আরও সুবিধা পাবেন।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, সকাল ও রাতের নতুন সময়সূচি চালু হওয়ার পর যাত্রী সংখ্যা ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
সময়সূচি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হচ্ছে।
রেলওয়ে পুলিশের পাশাপাশি ডিএমটিসিএলের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করবেন।
রাতে শেষ ট্রেন চলাচলের পর ট্র্যাক ও স্টেশনের নিয়মিত পরিদর্শন এবং রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমও চালানো হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মেট্রোরেলের সময় বৃদ্ধি শুধুমাত্র পরিবহন খাতে নয়, অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ঢাকার যানজটে প্রতি বছর যে পরিমাণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, তা কমাতে সহায়তা করবে এই সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে,
ঢাকার যানজটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
যদি মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহন সেবা দীর্ঘ সময় চালু থাকে, তাহলে সেই ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, সময়সূচি বৃদ্ধির পাশাপাশি যাত্রীদের সুবিধার্থে নতুন কিছু প্রযুক্তি ও সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ডিজিটাল সময়সূচি ডিসপ্লে: প্রতিটি স্টেশনে রিয়েল-টাইম ট্রেন আগমন ও প্রস্থানের তথ্য দেখানো হবে।
- ই-টিকেটিং অ্যাপ: যাত্রীরা মোবাইল থেকে টিকিট কিনতে ও রিচার্জ করতে পারবেন।
- অটোমেটিক গেট আপডেট: যাত্রী ভিড়ের সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খোলা ও বন্ধের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
সময়সূচি বাড়ানোর ঘোষণার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অনেকে বলেছেন, এটি “ঢাকা শহরের জন্য সবচেয়ে ভালো খবরগুলোর একটি।”
একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন,
“বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ৮টার ক্লাস ধরতে কষ্ট হতো। এখন মেট্রোরেলেই যেতে পারব।”
আরেকজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন,
“রাতের দিকে দোকান বন্ধ করে ফেরার সময় ট্যাক্সি পাওয়া যেত না। এখন রাত ১০টা পর্যন্ত ট্রেন থাকায় ভরসা পাচ্ছি।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সময় বৃদ্ধির ফলে:
- সকাল ও রাতের যাত্রীচাপ কমে যাবে,
- গণপরিবহনে নির্ভরতা বাড়বে,
- যানজট কমে অর্থনৈতিক দক্ষতা বাড়বে,
- পরিবেশ দূষণও কিছুটা হ্রাস পাবে,
- কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও দ্রুত চলাচল করতে পারবেন।
ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় মেট্রোরেল ইতিমধ্যেই এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে। এবার সময়সূচি বাড়ানোর মাধ্যমে এটি আরও জনবান্ধব ও কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থায় পরিণত হলো।
ডিএমটিসিএলের ভাষায়,
“আমরা চাই প্রতিটি নাগরিক সময়মতো, স্বস্তিতে ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাক। সময় বৃদ্ধি সেই লক্ষ্য পূরণের একটি বড় পদক্ষেপ।”