৪৬ জন পরীক্ষার্থীই জিপিএ-৫, অধ্যক্ষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ আবারও প্রমাণ করল তাদের অনন্য শিক্ষাগত উৎকর্ষতা। ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে। কলেজের ৪৬ জন পরীক্ষার্থীই জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, যা এক অসাধারণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এদের মধ্যে ৪২ জন বিজ্ঞান বিভাগের এবং ৪ জন মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—২২ জন শিক্ষার্থী গোল্ডেন এ-প্লাস (GPA 5 in all subjects) অর্জন করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সারা দেশের সঙ্গে একযোগে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলাফল ঘোষণার পরপরই মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থীরা একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে অভিনন্দন জানায়, শিক্ষক ও অভিভাবকরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দধ্বনি—‘আমরা পারি, আমরাই সেরা!’
কলেজের অধ্যক্ষ কর্নেল এস এম ফয়সল বলেন,
“শিক্ষার্থীদের নিরলস অধ্যবসায়, শিক্ষক মণ্ডলীর তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকদের আন্তরিক সহযোগিতায় এই অসাধারণ সাফল্য এসেছে। এটি আমাদের গর্বের অর্জন।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা শুধু ফলাফলে নয়, চরিত্র গঠনেও গুরুত্ব দিই। এই শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে।”
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সাফল্য হঠাৎ আসেনি। এটি বহু বছরের শৃঙ্খলা, নিয়মিত পাঠদান, প্রশিক্ষণ ও মানসম্পন্ন শিক্ষার ফল।
প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একযোগে শিক্ষা, নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও দেশপ্রেম গড়ে তোলা হয়।
শিক্ষকরা জানান, প্রতিদিন ক্লাসের পরেও শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী পুনরাবৃত্তি করে। প্রতিটি বিষয়ের দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য থাকে বিশেষ কোচিং ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা।
একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন,
“আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, জীবনের জন্য প্রস্তুত করি। তাদের সাফল্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতার প্রতিফলন।”
এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থী ক্যাডেট মাহিম হাসান বলেন,
“প্রতিদিনের কঠোর পরিশ্রমের ফল এটি। আমাদের শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে থেকেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা গর্বিত যে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের নাম উজ্জ্বল রাখতে পেরেছি।”
আরেক শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম তানহা বলেন,
“আমরা কখনোই শুধুমাত্র পরীক্ষার চিন্তা করিনি। প্রতিদিনের শেখা ও অনুশীলনের মধ্যেই আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। আজ তারই ফল পেয়েছি।”
ফলাফল ঘোষণার পর কলেজের প্রধান ফটকে অভিভাবকদের ভিড় দেখা যায়। অনেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তোলেন, কেউ কেউ আনন্দে কেঁদে ফেলেন।
একজন অভিভাবক বলেন,
“আমার ছেলেকে ভর্তি করানোর সময় ভেবেছিলাম, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ শেখাবে এই প্রতিষ্ঠান। আজ দেখি, তারা শুধু ভালো মানুষই নয়, মেধাবী নাগরিক হিসেবেও তৈরি হচ্ছে।”
২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ৪৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। এবার ৪৬ জনই জিপিএ-৫ পাওয়ায় এটি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সাফল্য।
এই ধারাবাহিক উন্নতি নিয়ে কলেজ প্রশাসন আশাবাদী যে, ভবিষ্যতেও তারা জাতীয় পর্যায়ে আরও বড় অর্জন আনতে পারবে।
বাংলাদেশের ১২টি ক্যাডেট কলেজের মধ্যে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ সবসময়ই সেরা তিনের মধ্যে থাকে। এবারও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে তারা।
শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাডেট কলেজগুলোর গড় ফলাফল দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। যেখানে জাতীয় গড় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার ১৫ শতাংশ, সেখানে ক্যাডেট কলেজগুলোতে প্রায় ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করে।
ফলাফল ঘোষণার পর শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব আলাদা বার্তায় দেশের সব ক্যাডেট কলেজকে অভিনন্দন জানান।
শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীন বলেন,
“ক্যাডেট কলেজগুলো দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক অনন্য মডেল। তারা শুধু শিক্ষার্থীদের মেধাবী করে তোলে না, বরং সুশিক্ষিত নাগরিক হিসেবেও গড়ে তোলে।”
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে। প্রতিটি ক্লাসে মাল্টিমিডিয়া ও ডিজিটাল প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়।
এছাড়া শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করে, যা তাদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়।
অধ্যক্ষ কর্নেল এস এম ফয়সল বলেন,
“আমরা চাই শিক্ষার্থীরা যুগোপযোগী জ্ঞান অর্জন করুক। তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরেও তাদের প্রযুক্তি, রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পরিবেশবিজ্ঞান শেখানো হচ্ছে।”
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ শুধু একাডেমিক ফলাফলে নয়, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা—সবক্ষেত্রেই সমানভাবে সফল।
২০২৫ সালের শুরুতে তারা জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে এবং আন্তঃক্যাডেট কলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়।
এই বহুমাত্রিক অর্জন তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশের অন্যতম সেরা অবস্থানে নিয়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও কলেজের সাফল্যে গর্বিত। অনেকেই দেশের প্রশাসন, সেনাবাহিনী, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছেন।
একজন প্রাক্তন ক্যাডেট জানান,
“আমরা যেখানে আছি, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা ও মূল্যবোধ আমাদের পথপ্রদর্শক। আজকের এই ফলাফল দেখে গর্বে বুক ভরে গেল।”
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগামী বছর থেকেই তারা আরও উন্নত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে চায়। আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম, ডিজিটাল ল্যাব ও উন্নত ভাষা প্রশিক্ষণ সুবিধা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
অধ্যক্ষ বলেন,
“আমাদের লক্ষ্য শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা।”
ক্যাডেট কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বিশেষ দিক হলো নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের চর্চা। শিক্ষার্থীদের নিয়মিতভাবে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, রক্তদান ও সমাজসেবায় অংশ নিতে উৎসাহিত করা হয়।
এই নৈতিক শিক্ষাই তাদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে এবং সঠিক পথে চলতে সহায়তা করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অর্জন শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের নয়—এটি বাংলাদেশের শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রতীক।
যেখানে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামো সমস্যা বিদ্যমান, সেখানে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ দেখাচ্ছে ‘গুণগত শিক্ষার বাস্তব উদাহরণ’।
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের এই শতভাগ সাফল্য প্রমাণ করে, পরিশ্রম, শৃঙ্খলা ও দৃঢ় নেতৃত্ব থাকলে কোনো লক্ষ্যই অসম্ভব নয়।
এটি শুধু প্রতিষ্ঠানটির নয়, বরং গোটা দেশের শিক্ষা খাতের জন্য এক অনুপ্রেরণা।
অধ্যক্ষের ভাষায়,
“আমাদের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাদের সাফল্য মানে জাতির সাফল্য।”