দেড় শতাধিক স্বাক্ষরিত ব্যালট পেপার উদ্ধার, প্রিজাইডিং অফিসার স্বীকার করলেন নিয়মভঙ্গ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বহুল প্রতীক্ষিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ভোট চলাকালীন সময়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমি ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে পাওয়া গেছে দেড় শটিরও বেশি আগে থেকে স্বাক্ষর করা ব্যালট পেপার, যা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগ।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবির এ বিষয়ে অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন,
“ভোটার আসার আগেই শতাধিক ব্যালটে প্রিজাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর দেওয়া হয়েছে। এটি অনিয়ম ও কারচুপির স্পষ্ট উদাহরণ।”
এ ঘটনায় রাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
নির্বাচনী নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার পর প্রিজাইডিং অফিসার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে স্বাক্ষর দিয়ে তা ভোটারকে হস্তান্তর করবেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ভোটারদের আগেই ১৫০টির বেশি ব্যালট পেপার স্বাক্ষর করে টেবিলের নিচে রাখা হয়েছিল।
ছাত্রদল সমর্থিত এজেন্টরা দাবি করেন, এই ব্যালটগুলো জাল ভোট দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
“আমরা টেবিলের নিচে রাখা ব্যালটগুলো দেখতে পাই। এগুলো আগেই স্বাক্ষর করা, অথচ কোনো ভোটার তখনও কেন্দ্রে আসেনি,” বলেন এক ছাত্রদল এজেন্ট।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমান স্বীকার করেছেন, নিয়ম ভাঙা হয়েছে। তবে তার দাবি, বাইরে লম্বা লাইন ও সময় বাঁচানোর জন্য ব্যালটগুলো আগে থেকে স্বাক্ষর করা হয়।
তিনি বলেন,
“ভোট দিতে আসা শিক্ষার্থীদের ভিড় অনেক। তাই সময় বাঁচাতে কিছু ব্যালটে আগেই স্বাক্ষর দিয়েছিলাম। এতে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে, তবে কারচুপির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।”
এই বক্তব্য আরও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, কারণ নিয়মভঙ্গ স্বীকার করলেও বিষয়টিকে তিনি ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন হচ্ছে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এরপর থেকে নানা কারণেই এই নির্বাচন বন্ধ ছিল।
এবারের নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস, প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক আগ্রহ। সকাল ৯টা থেকে শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ভোট শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ফল গণনা শুরু করার কথা রয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম জানান,
“রাকসুর ২৩টি পদে ৩০৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫৮ জন। ১৭টি হল সংসদের ২৫৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫৫৫ প্রার্থী।”
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ২৮,৯০১ জন, যার মধ্যে ৩৯ দশমিক ১০ শতাংশ নারী এবং ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ পুরুষ।
ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেল অভিযোগ করেছে যে, রাকসু নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারপন্থী প্যানেলগুলোর সুবিধা দিতে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবির বলেন,
“রাকসুর ইতিহাসে এমন নির্লজ্জ অনিয়ম আমরা কল্পনাও করিনি। ভোটার আসার আগে ব্যালটে স্বাক্ষর মানে নির্বাচন প্রক্রিয়া আগেই বিকৃত করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। অবিলম্বে ওই কেন্দ্রের ভোট বাতিল ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও পরে এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানানো হয়, ঘটনার তদন্ত চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়,
“নির্বাচন কমিশন বিষয়টি অবগত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে, এটি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি। তবে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম বলেন,
“আমরা ঘটনা শুনেছি। প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকেও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের সমর্থকদের মধ্যে মৌখিক বিতণ্ডা দেখা দেয়। ক্যাম্পাসের কয়েকটি পয়েন্টে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন,
“আমরা চেয়েছিলাম নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু আজকের ঘটনায় সেই আশা ধুলিস্যাৎ হলো।”
আরেক শিক্ষার্থী বলেন,
“৩৫ বছর পর রাকসু ফিরল, কিন্তু যদি এর শুরুতেই কারচুপি হয়, তবে ভবিষ্যতে কেউ আর এই নির্বাচনের প্রতি আস্থা রাখবে না।”
বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে স্বচ্ছতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহমুদ হাসান বলেন,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু দেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত।
ইতিহাস বলছে, রাকসু থেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা উঠে এসেছেন। তাই এই নির্বাচন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিরও প্রতিফলন
বিকেল নাগাদ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভোটগ্রহণ অব্যাহত থাকবে। কোনো কেন্দ্রের ভোটে অনিয়ম প্রমাণিত হলে সেই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত বা পুনরায় গ্রহণ করা হতে পারে।
অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম বলেন,
“আমরা চাই শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস রাখুক। অভিযোগ পেলেই তদন্ত করা হচ্ছে। নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে কিনা, তা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের কাছে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের নতুন সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু ভোটের দিনেই কারচুপির অভিযোগে সেই আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে।
ছাত্র ইউনিয়নের এক প্রার্থী বলেন,
“আমরা এই নির্বাচনকে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি মাইলফলক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের শিথিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব এই প্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে অনিয়ম নতুন নয়। তবে এবারকার ঘটনা কয়েকটি কারণে বিশেষভাবে আলোচনায়—
- ৩৫ বছর পর নির্বাচন হওয়া
- একাডেমিক ভবনের ভেতরে অনিয়ম ধরা পড়া
- প্রিজাইডিং অফিসারের স্বীকারোক্তি
- অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের ব্যর্থতা এ ধরনের ঘটনার মূল কারণ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীরা যে গণতান্ত্রিক চর্চার নবজাগরণের আশা করেছিল, সেটি ব্যালট কারচুপির অভিযোগে এখন গভীর সংকটে পড়েছে।
ঘটনার তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, এটি শুধু রাবি নয়, পুরো দেশের শিক্ষাঙ্গনের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
নির্বাচন কমিশনের কাছে শিক্ষার্থীদের একটাই প্রত্যাশা—
“আমাদের ভোট যেন আমাদের হাতে থাকে, টেবিলের নিচে নয়।”