শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীনের ঘোষণা, বাড়িভাড়াসহ সব দাবির সুরাহা হবে
বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীন জানিয়েছেন, অচিরেই দেশের জন্য নতুন জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা করা হবে। এতে শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা, মূল বেতন সমন্বয়সহ একাধিক দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন,
“কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় বেতন স্কেল হবে ইনশাআল্লাহ। তখন শিক্ষকদের বাড়িভাড়াসহ বেতনের বিষয়গুলোও সুরাহা হয়ে যাবে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
তার এই ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষক সমাজে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন বৈষম্য, বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি, এবং মহাখাতভিত্তিক সমন্বয়ের দাবি জানিয়ে আসছেন।
তাদের অভিযোগ, বিদ্যমান বেতন কাঠামোয় শিক্ষক পেশা এখনও অন্যান্য প্রশাসনিক বা কারিগরি খাতের তুলনায় পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাস্তব ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষা সচিব বলেন,
“শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। অর্থ উপদেষ্টা ও সচিব বর্তমানে দেশের বাইরে থাকলেও আমরা থেমে নেই। দিনরাত কাজ করছি সমাধানের জন্য।”
সংবাদ সম্মেলনে রেহানা পারভীন জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় বেতন স্কেল প্রণয়ন কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটি সম্পন্ন হলে শুধু শিক্ষক নয়, সব সরকারি খাতের কর্মীদের বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হবে।
তিনি বলেন,
“এটা এক দিনের কাজ নয়। কিন্তু আমরা প্রতিটি ধাপেই অগ্রসর হচ্ছি। আলোচনায় বসলে একটি চূড়ান্ত সমাধান বের হবে। এটা শুধু অর্থ বরাদ্দ নয়, একটি সামগ্রিক উত্তোরণ।”
সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য পৃথক গ্রেড সমন্বয় এবং নগরভিত্তিক বাড়িভাড়া পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষকদের বেতন অনেকাংশে “লামছাম বরাদ্দ”-এর ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষা সচিব বলেন,
“আমরা লামছাম বরাদ্দ থেকে শতাংশের হিসেবে যাচ্ছি। এটি একটি বড় পরিবর্তন, কারণ এতে শিক্ষকরা সরাসরি তাদের স্কেলের শতকরা হারে সুবিধা পাবেন।”
এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বেতন নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষক সংগঠনগুলো সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান বলেন,
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বেতন স্কেলের দাবি করে আসছি। শিক্ষা সচিবের বক্তব্যে আমরা আশাবাদী। তবে এখন চাই বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট সময়সূচি।”
বেসরকারি শিক্ষক ফোরামের সভাপতি রুবিনা ইসলাম বলেন,
“বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এমপিওভুক্তির পর দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেতন বৈষম্য। নতুন বেতন স্কেলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা আশাবাদী।”
বাংলাদেশে সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়িত হয়েছিল ২০১৫ সালে। এর পর থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নগর ভাড়া বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলেও শিক্ষকদের ভাতা ও গ্রেড পরিবর্তন হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা খাতকে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখা হলেও শিক্ষকদের আর্থিক সুরক্ষা না থাকলে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
শিক্ষা গবেষক ড. তানভীর আহমেদ বলেন,
“শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা শুধু তাদের নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে শিক্ষককে সম্মান ও প্রণোদনা দিতে হবে।”
বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। শহরাঞ্চলে বাড়িভাড়া ও জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের জন্য সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষক মো. সাদুল হক বলেন,
“বেতন অনুযায়ী ভাড়া দিতে গেলে প্রায় অর্ধেক বেতন চলে যায়। এর পর পরিবার, সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা—সব মেলানো কঠিন।”
এই পরিস্থিতিতে নতুন বেতন স্কেল শিক্ষকদের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব আয় ব্যয়ের তুলনায় ধীর গতিতে বাড়ছে। ফলে একযোগে সব খাতে বেতন বৃদ্ধি করা অর্থনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী হাসান বলেন,
“জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন সরকারের ব্যয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, কারণ এতে কর্মীদের কর্মদক্ষতা ও মনোবল বাড়বে।”
শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীন নিজেও বাংলাদেশের প্রশাসনে নারী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তার দিকনির্দেশনায় গত দুই বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একাধিক সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে।
তিনি বলেন,
“আমরা শুধু বেতন নয়, শিক্ষা খাতের সামগ্রিক গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করছি। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল ক্লাসরুম, ও ন্যায্য প্রণোদনা—সব কিছুই সমন্বিতভাবে বিবেচনা করছি।”
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে—
- বেসিক বেতনে ২৫-৩০% বৃদ্ধি
- নগরভিত্তিক বাড়িভাড়া — ঢাকায় সর্বোচ্চ ৬০%, বিভাগীয় শহরে ৫০%, জেলা শহরে ৪০%
- চিকিৎসা ভাতা দ্বিগুণ
- পরিবহন ও প্রশিক্ষণ ভাতা সংযোজন
- প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্স বোনাস— বছরে একবার
- শিক্ষক পদোন্নতির গ্রেড ফ্লেক্সিবিলিটি
যদিও চূড়ান্ত কাঠামো এখনো নির্ধারণ হয়নি, তবে শিক্ষা সচিবের বক্তব্যে পরিষ্কার—“সবার জন্য ন্যায্যতা নিশ্চিত করা”ই মূল লক্ষ্য।
নতুন বেতন স্কেল কার্যকর হলে এর প্রভাব পড়বে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায়। শিক্ষকরা আরও উৎসাহিত হয়ে শিক্ষাদানে মনোযোগী হবেন। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছে শিক্ষকতা পেশা আবারও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেতন সংস্কার শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নয়—এটি এক ধরনের সামাজিক বিনিয়োগ।
অধ্যাপক রুবাইয়া সুলতানা বলেন,
“শিক্ষককে মর্যাদা দেওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে বিনিয়োগ করা। নতুন বেতন কাঠামো যদি ন্যায়সংগত হয়, তবে এটি বাংলাদেশের শিক্ষা মানে এক বিপ্লব আনবে।”
শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীনের ঘোষণায় শিক্ষাক্ষেত্রে এখন নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। শিক্ষক সমাজ দীর্ঘদিন পর এমন প্রতিশ্রুতি শুনে উচ্ছ্বসিত। যদিও চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগে অনেক প্রশাসনিক ধাপ বাকি, তবুও এটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এক নতুন অধ্যায় হতে যাচ্ছে।
শিক্ষা সচিবের ভাষায়—
“আমরা শুধু বেতন নয়, সম্মান ও মর্যাদা ফেরাতে চাই। শিক্ষকরা আমাদের জাতির নির্মাতা—তাদের প্রাপ্য সম্মান আমরা দিতে চাই।”
যদি এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে শিক্ষকদের মুখে আবারও হাসি ফুটবে, এবং শিক্ষা খাতে আসবে নতুন প্রাণ।