ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সাধারণ মানুষের কেনাকাটা কমে গেছে। বড় ধরনের খরচ বা বিনিয়োগে এখন কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত—নির্মাণ খাতে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ড্যাপ (ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) সংশোধন না হওয়ায় নতুন কোনো প্রকল্পের অনুমোদন মিলছে না, ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে নির্মাণ শিল্পের কর্মযজ্ঞ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের ভবন নির্মাণসামগ্রীর দাম কমেছে ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নির্মাণকাজ কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের মজুরিও কমেছে। কাজের অভাবে অনেক শ্রমিক এখন বেকার সময় কাটাচ্ছেন।
উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ এখন ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলে গেছেন। বিয়ে, বাসা পরিবর্তন বা ভবন নির্মাণের মতো বড় খরচে অনীহা দেখা দিয়েছে। এর ফলে নতুন ভবন নির্মাণ কার্যক্রমে পিছুটান দিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ঠিকাদাররা।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে নির্মাণসামগ্রীর গড় মূল্যস্ফীতি ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত এপ্রিলে ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। এপ্রিলের পর থেকে প্রতি মাসেই এ খাতের মূল্যস্ফীতি কমছে। শুধু ভবন নির্মাণসংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বাড়ার হার সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যেখানে এপ্রিল মাসে তা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ায় বাজারে দামও স্থিতিশীল বা নিম্নমুখী হচ্ছে। তবে এটি খাতটির জন্য ইতিবাচক নয়; বরং স্থবির অর্থনীতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে মিল রেখে নির্মাণ খাতের উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, সরকারি উন্নয়ন কাজও স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দ থাকলেও অনেক ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন বা কাজ বন্ধ রেখেছেন। পরিকল্পনা উপদেষ্টা সম্প্রতি জানিয়েছেন, বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় দুই শতাধিক ঠিকাদার পালিয়ে যাওয়ায় উন্নয়ন কার্যক্রম থেমে গেছে।
ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও প্রায় স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
নির্মাণ খাতের অন্যতম বড় ব্যয় পরিবহন খাতে। সিমেন্ট, রড, বালু, ইটসহ পণ্য পরিবহনে খরচ গত ছয় মাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বরে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যেখানে গত এপ্রিল মাসে বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।
অর্থাৎ নির্মাণসামগ্রীর পরিবহনে খরচের চাপ কিছুটা কমলেও সামগ্রিকভাবে নির্মাণকাজ না থাকায় ট্রাক ও শ্রমিক উভয়েরই আয় কমে গেছে।
নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হারও সেপ্টেম্বরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে শ্রম মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা গত এপ্রিল মাসে ছিল ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি উদ্বেগজনক প্রবণতা। কারণ নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকাংশই দিনমজুর, যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। কাজ না থাকায় তারা আর্থিক সংকটে পড়ছেন। অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন বা বিকল্প পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ (ড্যাপ) অনুমোদন না হওয়ায় নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পরিচালক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, “নির্মাণ খাতের স্থবিরতার দুটি মূল কারণ আছে। প্রথমত, রাজউকের বিধিমালার কোনো গেজেট এখনো প্রকাশ হয়নি, ড্যাপ সংশোধনও হয়নি। ফলে পুরো ঢাকা শহরে নতুন প্রকল্প অনুমোদন বন্ধ আছে।”
তিনি আরও বলেন, “দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না কেউ। রাজউকের অনুমোদন না থাকায় কাজও কম, আর কাজ না থাকলে নির্মাণসামগ্রীর চাহিদাও কমে যায়।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্মাণ খাতের এই স্থবিরতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, নির্মাণ খাত কৃষির পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান নির্ভর খাত। এ খাতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সিমেন্ট, রড, ইট, বালু, পেইন্ট, ইলেকট্রিক্যাল এবং পরিবহনসহ শতাধিক উপখাত।
যদি দ্রুত ড্যাপ সংশোধন না হয় এবং নতুন প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু না হয়, তাহলে বেকারত্ব আরও বাড়বে। একইসঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়বে, যা আর্থিক প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্যাপ সংশোধন দ্রুত সম্পন্ন করে অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করা, কর প্রণোদনা দেওয়া এবং নির্মাণসামগ্রীর আমদানি শুল্ক পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্মাণ খাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম সূচক। এই খাত যখন সক্রিয় থাকে, তখন শ্রমবাজার, পণ্য পরিবহন, ব্যাংকিং ও শিল্প উৎপাদন—সব ক্ষেত্রেই গতিশীলতা আসে।
কিন্তু বর্তমানে এই খাতের স্থবিরতা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ তৈরি করছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।