ডেস্ক রিপোর্ট │ সকলের কণ্ঠ
কীওয়ার্ড: বিনিয়োগ প্রতারণা, শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ, ক্রিপ্টো প্রতারণা, অনলাইন প্রতারণা, অর্থনৈতিক দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কারসাজি, ব্যাংক লুটপাট, বীমা প্রতারণা
দেশজুড়ে বিনিয়োগের নামে চলছে একের পর এক ভয়াবহ প্রতারণা। অনলাইন কিংবা অফলাইনে, অ্যাপসভিত্তিক বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে শরিয়াহভিত্তিক প্রকল্প পর্যন্ত—সব জায়গায় লোভনীয় মুনাফার প্রতিশ্রুতিতে প্রলুব্ধ হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কেউ ব্যাংকে, কেউ শেয়ারবাজারে, কেউ আবার তথাকথিত ‘হালাল বিনিয়োগে’ অর্থ রেখে হয়েছেন নিঃস্ব। অথচ প্রতারক চক্রের বেশির ভাগই এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আর্থিক খাতে গভীর সংকট ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা
অর্থনীতিবিদদের মতে, গত এক দশকে দেশের আর্থিক খাত দুর্নীতি ও লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, “রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিবাজ চক্র সাধারণ মানুষের সঞ্চয় লুট করেছে।” ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার—সব ক্ষেত্রেই লুটপাট, অনিয়ম ও অর্থপাচারের মহোৎসব চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
ফলে ধ্বংসের মুখে পড়েছে বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নিঃস্ব হয়েছেন লাখো মানুষ। অন্যদিকে এসব লুটের অর্থে দেশ-বিদেশে প্রাচুর্যের পাহাড় গড়ে তুলেছে এক শ্রেণির ক্ষমতাবান রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও আমলারা।
স্বল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফার লোভ—প্রতারণার প্রধান অস্ত্র
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “অল্প সময়ে অধিক লাভের প্রলোভনই ডিজিটাল প্রতারণার মূল চালিকাশক্তি।” প্রতারকরা প্রথমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য সামান্য মুনাফা প্রদান করে। এতে অনেকেই আরো বড় অঙ্কের অর্থ ঢালেন এবং পরিচিতজনদেরও উৎসাহিত করেন। একসময় প্ল্যাটফর্ম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়—অ্যাপ, ওয়েবসাইট, গ্রুপ সব উধাও।
রিমা (ছদ্মনাম) নামের এক স্কুলশিক্ষক ফেসবুকভিত্তিক একটি বিনিয়োগ গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রথমে লাভ পেলেও, পরবর্তীতে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গহনা বন্ধক রেখে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। সপ্তাহ না যেতেই অ্যাপ ও গ্রুপ গায়েব হয়ে যায়। রিমার মতো হাজারো মানুষ প্রতিদিন এভাবে অনলাইন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডিজিটাল লুটের ফাঁদ
ক্রিপ্টোকারেন্সির নামেও চলছে ব্যাপক প্রতারণা। বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, বাইন্যান্স কয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রার নামে অনিয়ন্ত্রিত প্ল্যাটফর্মগুলো ‘দ্রুত মুনাফার’ আশায় মানুষকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করছে। কিন্তু এসব প্ল্যাটফর্মের কোনো নিয়ন্ত্রণ, আইনগত সুরক্ষা বা বাস্তব ঠিকানা নেই। বিনিয়োগ হারানোর পর অভিযোগ জানানোর পথও থাকে না বিনিয়োগকারীদের সামনে।
‘হালাল বিনিয়োগের’ নামে ধর্মপ্রাণ মানুষকে ফাঁদে ফেলা
‘সুদবিহীন শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ’ স্লোগান তুলে ধর্মপ্রাণ মানুষকে প্রতারণার জালে ফেলছে বিভিন্ন চক্র। পিরোজপুরের আলোচিত এহসান গ্রুপ এর বড় উদাহরণ—যেখানে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
বর্তমানে দেশজুড়ে ‘হালাল মার্চেন্টিং’, ‘শরিয়াহ কমপ্লায়েন্ট ফার্মিং’ ইত্যাদি নামে একই কৌশলে প্রতারণা চলছে। প্রথমদিকে নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হলেও, পরে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম, সংগঠকরা বিপুল অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যান।
ই-ভ্যালি, ডেসটিনি, যুবক—বড় বড় প্রতারণার ইতিহাস
বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রতারণার ইতিহাস দীর্ঘ। ডেসটিনি, ই-ভ্যালি, ইউনিপে টু ইউ ও যুবক—এসব প্রতিষ্ঠানের নাম এখনো মানুষের মনে ক্ষোভের প্রতীক।
- ডেসটিনি বিভিন্ন প্রকল্পের নামে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
- ই-ভ্যালি গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
অসংখ্য কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেও ভুক্তভোগীরা আজও অর্থ ফেরত পাননি। আইনগত প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘ হওয়ায় প্রতারকরা শেষ পর্যন্ত পার পেয়ে যায়।
গ্রামীণ নারী ও ক্ষুদ্রঋণের নামে প্রতারণা
প্রতারক চক্রের সহজ টার্গেট গ্রামীণ নারীরা। মাসিক চাঁদার মাধ্যমে সদস্য বানিয়ে বড় রিটার্ন বা বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভন দেখানো হয়। পর্যাপ্ত অর্থ জমলে প্রতিষ্ঠান ‘গায়েব’।
বগুড়ার শেরপুরে ‘আশার আলো মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে এমনই এক প্রতারণা সংঘটিত হয়। হাজারো দরিদ্র নারী তাদের জমানো টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের সমবায়ভিত্তিক প্রতারণা এখন নিত্যনৈমিত্তিক।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, “যারা অতিরিক্ত লাভের লোভ দেখায়, তাদের উদ্দেশ্যই প্রতারণা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সীমিত সক্ষমতার কারণে অনেক সময় গ্রামাঞ্চলের এসব প্রতিষ্ঠান নজরদারির বাইরে থেকে যায়।”
আর্থিক খাতে দেউলিয়াত্ব ও একীভূতকরণ প্রক্রিয়া
বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনার আমলে ব্যাংক খাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ নেয়। ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক বর্তমানে দেউলিয়া অবস্থায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক—এই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সাধারণ আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পাবেন কিনা, তা অনিশ্চিত। একইভাবে নয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও অবসায়নের মুখে।
শেয়ারবাজারে কারসাজি ও বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশ
শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’, ভুয়া কোম্পানি তালিকাভুক্তি ও লভ্যাংশ বঞ্চনা। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এর প্রধান শিকার। মশিউর সিকিউরিটিজ নামে এক ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান একাই প্রায় ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেড় হাজার বিনিয়োগকারী।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, “গত দেড় দশকে ব্যাংক থেকে বীমা—সব খাতেই অনিয়ম হয়েছে। বর্তমান কমিশন এসব অনিয়ম রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ধীরে ধীরে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরছে।”
বীমা খাতে প্রতারণা ও আটকে থাকা কোটি কোটি টাকা
বীমা খাতেও প্রতারণা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ভুয়া এজেন্ট, গোপন শর্ত ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ৫০ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। বর্তমানে প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকার দাবির অর্থ আটকে আছে বিভিন্ন কোম্পানিতে।
বীমা বিশেষজ্ঞদের মতে, “যেখানে তদারকি দুর্বল, সেখানে প্রতারণা বিকাশ লাভ করে।” অনেক গ্রাহক আজও বীমার দাবির অর্থ না পেয়ে বছরের পর বছর ঘুরছেন।
সর্বগ্রাসী দুর্নীতিই প্রতারণার মূলে
বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন সিস্টেমিক। ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার, প্রশাসন, আদালত—সবখানেই দুর্নীতির শেকড় গভীর। এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্র।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, “রাজনৈতিক মদতে লুটপাটের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।”
বিনিয়োগ এখন ঝুঁকির প্রতিশব্দ
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগ খাত এখন চরম অনিশ্চয়তায়। যেখানে রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতারণাকে প্রশ্রয় দেয়, সেখানে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় নিরাপদ থাকে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন বিনিয়োগ মানেই ‘আয়ের নিশ্চয়তা’ নয়—বরং ‘ঝুঁকির নতুন সংজ্ঞা’। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনি কাঠামোর পুনর্গঠন অপরিহার্য। নইলে বিনিয়োগ খাতের এই ভয়াবহ প্রতারণা রোধ করা সম্ভব হবে না।