ভারতের কেরালায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় হৃদরোগে মৃত্যু, শোকস্তব্ধ আফ্রিকা
আফ্রিকার রাজনীতির এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব রাইলা ওডিঙ্গা আর নেই। কেনিয়ার এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বুধবার (১৫ অক্টোবর) স্থানীয় সময় সকালে ভারতের কেরালা রাজ্যের দেবমাথা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
হাসপাতাল সূত্র ও স্থানীয় পুলিশ জানায়, সকালে নিয়মিত হাঁটতে বেরিয়ে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শুধু কেনিয়া নয়, পুরো আফ্রিকান রাজনীতিতে।
কেরালার এরনাকুলাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কৃষ্ণন এম জানিয়েছেন,
“রাইলা ওডিঙ্গা সকালে নিয়মিত হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন বোন, মেয়ে, ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ভারতীয় ও কেনিয়ান নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। হাঁটার সময় তিনি হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”
ভারতের স্থানীয় দৈনিক ‘মাথ্রুভূমি’ জানায়, ওডিঙ্গা গত কয়েকদিন ধরে কোচি শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে ওডিঙ্গাকে হাসপাতালে আনা হয়। আগমনের আগেই তার মৃত্যু ঘটে। আমরা সর্বাত্মক চিকিৎসা চেষ্টা করেছি, কিন্তু cardiac arrest-এর পর তার শরীর সাড়া দেয়নি।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এবং বিবিসি আফ্রিকা উভয়েই খবরটি নিশ্চিত করেছে। এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, রাইলা ওডিঙ্গা তার পরিবারের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় অবস্থান করছিলেন। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি সেখানে একটি ব্যক্তিগত রিট্রিটে ছিলেন।
ওডিঙ্গার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো, সাবেক প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গভীর শোক প্রকাশ করেন।
রুটো এক বিবৃতিতে বলেন,
“রাইলা ওডিঙ্গা শুধু কেনিয়ার নয়, আফ্রিকার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন। তার মৃত্যু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে।”
রাইলা আমোলো ওডিঙ্গা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ৭ জানুয়ারি, কেনিয়ার কিসুমু কাউন্টির মাসেনো এলাকায়। তিনি ছিলেন কেনিয়ার প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট জারামোগি ওগিঙ্গা ওডিঙ্গা’র পুত্র—যিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন।
রাইলা ওডিঙ্গা উচ্চশিক্ষা লাভ করেন জার্মানির মাগডেবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং শাসক দল কেনিয়া আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (KANU)-এর বিরুদ্ধে শক্ত বিরোধিতা গড়ে তোলেন।
১৯৮২ সালে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের অভিযোগে তাকে বন্দি করা হয় এবং প্রায় ছয় বছর কারাবাসে কাটাতে হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ওডিঙ্গা কেনিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ওডিঙ্গার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার মূলত জনগণের অধিকার, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তিনি কেনিয়ার গণতান্ত্রিক সংস্কারের অন্যতম স্থপতি হিসেবে পরিচিত।
২০০২ সালে ওডিঙ্গার সমর্থনেই মোয়ি শাসনামলের অবসান ঘটে, যখন মোয়ি কিবাকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় ঐক্য সরকারের অধীনে কেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তার নেতৃত্বে ২০১০ সালে কেনিয়া একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যা আফ্রিকার অন্যতম উদার গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর জোসেফ ওদেম্বো বলেন,
“রাইলা ওডিঙ্গা কখনো ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। তিনি জনগণের জন্য, সংবিধানের জন্য, এবং দেশের আত্মার জন্য লড়াই করেছেন। তার অবদান প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে।”
রাইলা ওডিঙ্গা কেনিয়ার রাজনীতিতে ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে বিরোধীদলীয় নেতা, আন্দোলনকারী, কূটনীতিক ও জাতির অভিভাবক।
২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বলেন,
“এই নির্বাচনে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে।”
তার আন্দোলনের জেরে কেনিয়া তীব্র রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। তবে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট রুটোর সঙ্গে ঐতিহাসিক ‘হ্যান্ডশেক’ করে তিনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে দেশকে ফিরিয়ে আনেন।
সেই সময় তিনি বলেন,
“আমরা প্রতিশোধ নয়, পুনর্মিলনের রাজনীতি চাই। কেনিয়ার জনগণ শান্তি চায়, যুদ্ধ নয়।”
রাইলা ওডিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তাকে ভারতের কেরালায় পাঠানোর।
কোচির দেবমাথা হাসপাতালে তিনি দুই সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালের চিকিৎসক ড. মীনা নায়ার বলেন,
“তিনি অত্যন্ত নম্র, ধৈর্যশীল এবং সচেতন রোগী ছিলেন। চিকিৎসার প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অসাধারণ।”
তার মৃত্যুতে হাসপাতালের কর্মীরাও শোক প্রকাশ করেছেন। এক নার্স বলেন,
“আমরা শুধু একজন রোগী নয়, একজন মহান মানুষকে হারালাম।”
রাইলা ওডিঙ্গার মৃত্যু কেনিয়ার রাজনীতিতে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করেছে। বিশেষ করে বিরোধী শিবিরে এখন নেতৃত্বের অভাব দেখা দিয়েছে। তিনি ছিলেন অরেঞ্জ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (ODM) দলের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইসাবেল ওয়ানজিকু বলেন,
“রাইলার মতো নেতা এক যুগে একবার আসে। তিনি ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক, জনতার কণ্ঠস্বর। তার অনুপস্থিতিতে বিরোধী রাজনীতি নতুন পথ খুঁজবে।”
ওডিঙ্গা ২০২৭ সালের নির্বাচনে আবারও প্রার্থী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তার মৃত্যুর ফলে সেই রাজনৈতিক সমীকরণ একেবারে বদলে গেল।
ওডিঙ্গার মৃত্যুতে আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, এবং কমনওয়েলথ গভীর শোক জানিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুসা ফাকি মাহামাত এক বিবৃতিতে বলেন,
“রাইলা ওডিঙ্গা আফ্রিকার গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ঐক্যের প্রতীক ছিলেন। তার মৃত্যু আফ্রিকার জন্য এক অমূল্য ক্ষতি।”
এছাড়া, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটারে শোক প্রকাশ করে লেখেন,
“ভারত তার প্রিয় বন্ধুকে হারালো। ওডিঙ্গা ছিলেন ভারত-আফ্রিকা সম্পর্কের সেতুবন্ধ।”
রাইলা ওডিঙ্গা স্ত্রী আইডা ওডিঙ্গা এবং চার সন্তানের জনক ছিলেন। তার সন্তানদের মধ্যে রোজমেরি ওডিঙ্গা ইতিমধ্যেই সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়েছেন।
তার পরিবার জানিয়েছে, মরদেহ কেরালা থেকে নাইরোবিতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন করা হবে।
কেনিয়ার নাগরিক সমাজ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, ১৬ অক্টোবর থেকে দেশজুড়ে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হবে।
কেনিয়ার জনগণ তাকে ডাকত—“বাবা রাইলা” নামে। এই নামই প্রমাণ করে তার জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসার গভীরতা। তিনি ছিলেন একাধারে প্রতিবাদী, কূটনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিমূর্তি।
তার বিখ্যাত উক্তি ছিল:
“গণতন্ত্রের পথে হাঁটলে কখনও শর্টকাট নেই। তোমাকে কষ্ট পেতে হবে, রক্ত দিতে হবে, তবেই তুমি স্বাধীনতা পাবে।”
রাইলা ওডিঙ্গা তার জীবন দিয়ে সেই কথাই প্রমাণ করেছেন।
রাইলা ওডিঙ্গা কেবল কেনিয়ার নয়, সমগ্র আফ্রিকার রাজনীতির এক অনন্য অধ্যায়। তার মৃত্যুতে আফ্রিকার গণতন্ত্র হারালো এক মহান যোদ্ধা, এক দূরদর্শী চিন্তক, এবং এক অকৃত্রিম নেতা।
রাজনীতির উত্তাল সাগরে তিনি ছিলেন ন্যায়ের পালতোলা এক নাবিক। তার প্রস্থান কেনিয়ার রাজনীতিতে শুধু এক শূন্যতা নয়, বরং ইতিহাসে এক নতুন সূচনা।