হঠাৎ বদলিতে নতুন প্রশ্ন: প্রশাসনিক কারণ নাকি অন্য কিছু?
বগুড়া জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) থেকে এক ঝটকায় তিন কর্মকর্তাকে ক্লোজড করা হয়েছে। ডিবির অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইকবাল বাহার, ইন্সপেক্টর রাকিব হোসেন এবং এসআই মোহাম্মদ ফজলুল হক—এই তিনজন কর্মকর্তাকে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাজশাহী রেঞ্জের রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (আরআরএফ) রাজশাহী-তে সংযুক্ত (ক্লোজড) করা হয়।
রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে। অফিস আদেশে বলা হয়,
“প্রশাসনিক কারণে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা শাখার তিন কর্মকর্তাকে আরআরএফ রাজশাহীতে সংযুক্ত করা হলো। একইসঙ্গে তাদের মঙ্গলবারই ছাড়পত্র প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হলো।”
এই হঠাৎ বদলিতে বগুড়া জেলা পুলিশের ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ওসি ইকবাল বাহার ও তার সহকর্মীরা সম্প্রতি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
বগুড়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. আসাদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,
“রাজশাহী রেঞ্জ থেকে আমরা অফিস আদেশ পেয়েছি। আদেশ অনুযায়ী পরবর্তী করণীয় কার্যকর হবে। তবে কেন হঠাৎ করে তাদের ক্লোজড করা হলো—সেটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি।”
এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়, জেলা প্রশাসনের নিম্নস্তরেও এই সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
সাধারণত, পুলিশের কোনো কর্মকর্তাকে “ক্লোজড” করার অর্থ হলো—তাকে সাময়িকভাবে দায়িত্বমুক্ত রেখে অন্য স্থানে সংযুক্ত করা। এটি সরাসরি শাস্তিমূলক নয়, তবে কোনো বিশেষ তদন্ত, অভিযোগ বা প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত হিসেবেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“যখন বলা হয় ‘প্রশাসনিক কারণে ক্লোজড’, তখন এর ভেতরে সাধারণত কোনো না কোনো তদন্ত বা অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের বিষয় থাকে। সবসময় কারণ প্রকাশ করা হয় না, কারণ সেটি তদন্তের অংশ।”
তবে এই ঘটনার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সংবেদনশীল, কারণ বগুড়ার ডিবি পুলিশ সম্প্রতি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাদক ও অস্ত্র মামলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। ফলে অনেকেই মনে করছেন, কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অসন্তোষ বা চাপের কারণেও এই সিদ্ধান্ত হতে পারে।
ওসি ইকবাল বাহার দীর্ঘদিন ধরে বগুড়া ডিবির দায়িত্বে ছিলেন এবং একাধিক আলোচিত মামলার তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ২০২৪ সালের শেষ দিকে বগুড়ায় সংঘটিত কয়েকটি অপহরণ, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে তার নেতৃত্বে ডিবি পুলিশ সাফল্য পেয়েছিল।
তবে স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি কিছু সংবেদনশীল অভিযানে সরাসরি জড়িত ছিলেন, যা স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একজন স্থানীয় সাংবাদিক বলেন,
“ইকবাল বাহার এমন একজন কর্মকর্তা যিনি আপসহীনভাবে কাজ করতেন। অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করায় তার বিরাগভাজন তৈরি হয়েছিল।”
রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় থেকে প্রেরিত আদেশে কেবল “প্রশাসনিক কারণ” উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোনো নির্দিষ্ট কারণ, তদন্ত বা অভিযোগের কথা বলা হয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন,
“প্রশাসনিক কারণে ক্লোজড করা মানে হতে পারে—উচ্চপর্যায়ে কোনো তদন্ত চলছে, অথবা কোনো অভ্যন্তরীণ রিপোর্টের ভিত্তিতে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।”
তবে এই আদেশটি সাধারণ ক্লোজিং নয়, কারণ একসঙ্গে তিন কর্মকর্তাকে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পুনর্গঠন ছাড়া ঘটে না।
গত এক বছরে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা শাখা একাধিক বড় অভিযানে সফলতা পেয়েছিল। বিশেষ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ, চুরি-ছিনতাই দমন, অস্ত্র উদ্ধার ও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ডিবির কার্যক্রম প্রশংসিত হয়।
২০২৫ সালের শুরুতে বগুড়ার ডিবি একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে, যা সারাদেশে আলোচিত হয়। সেই মামলার তদন্তেও ইকবাল বাহার প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে তার ক্লোজড হওয়া স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—এটি কি নিয়মিত প্রশাসনিক বদলি, নাকি কোনো গভীরতর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রতিফলন?
রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ প্রশাসনে সম্প্রতি কর্মকর্তা মূল্যায়ন (পারফরম্যান্স রিভিউ) প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়েছে। এ সময় যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ বা শৃঙ্খলাভঙ্গের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাদের অস্থায়ীভাবে ক্লোজড করা হয়।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
“রেঞ্জ পর্যায়ে এখন জিরো টলারেন্স নীতি চালু আছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে প্রথমে তাকে ক্লোজড করে তথ্য যাচাই করা হয়। তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে পরবর্তীতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
তবে এখন পর্যন্ত বগুড়া ডিবির এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ।
অনেকেই মনে করেন, “ক্লোজড” হওয়া মানে শাস্তি পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। পুলিশের প্রশাসনিক পরিভাষায় ক্লোজড মানে হলো—
“দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের সুযোগ তৈরি করা।”
একজন পুলিশ প্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন,
“কোনো কর্মকর্তা যখন তদন্তাধীন অবস্থায় দায়িত্বে থাকেন, তখন অনেক সময় তথ্য প্রভাবিত করার আশঙ্কা থাকে। তাই তাকে সাময়িকভাবে অন্যত্র সংযুক্ত করা হয়। এটা কখনো কখনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপও হতে পারে।”
বগুড়া শহরে এ ঘটনার পর থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে নানা গুঞ্জন চলছে। কেউ বলছেন, এটি “উপরের নির্দেশ”, আবার কেউ বলছেন, “ভিতরের কোন্দলের ফল”।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন—
“যেসব কর্মকর্তা সদ্য একাধিক সাফল্য দেখিয়েছেন, তাদের হঠাৎ ক্লোজড করা হলো কেন?”
অন্যদিকে, বগুড়া জেলা পুলিশের একটি অংশ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলছে, এটি প্রশাসনিক নিয়মের অংশ এবং এতে কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা খোঁজার দরকার নেই।
এর আগেও দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিকবার ডিবি বা থানার কর্মকর্তাদের হঠাৎ ক্লোজড করা হয়েছে। যেমন—২০২৩ সালে কুমিল্লায় ডিবির পাঁচ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে রাজশাহীতে সংযুক্ত করা হয় একটি মাদক মামলার তদন্তে অনিয়মের অভিযোগে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরবর্তীতে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পুনরায় পদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফলে বগুড়ার এই তিন কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
জননিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. আহসান হাবিব বলেন,
“পুলিশের ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ক্লোজড একটি কার্যকর প্রক্রিয়া, তবে এটির যথাযথ ব্যাখ্যা না দিলে এটি বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রশাসন যদি স্বচ্ছতা বজায় রাখতে চায়, তাহলে কারণটি প্রকাশ করা উচিত।”
তিনি আরও বলেন,
“যদি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকে, তবে জনগণের আস্থা ধরে রাখতে এই ধরনের হঠাৎ সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি জানানো জরুরি।”
রাজশাহী রেঞ্জের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, ক্লোজড হওয়া কর্মকর্তাদের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে। প্রতিবেদন সম্পন্ন হলে তাদের ভবিষ্যৎ পদায়ন নির্ধারণ করা হবে।
অন্যদিকে, বগুড়া জেলা পুলিশের মধ্যে নতুন করে ডিবির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
একজন জেলা পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,
“যতদিন না নতুন ওসি যোগ দিচ্ছেন, ততদিন ডিবির দৈনন্দিন কার্যক্রম সিনিয়র এসআইদের তত্ত্বাবধানে চলবে।”
বগুড়ার ডিবি থেকে একযোগে তিন কর্মকর্তাকে ক্লোজড করার ঘটনা নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত না রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী কোনো ইঙ্গিত—তা এখনো পরিষ্কার নয়।
তবে এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে পুলিশ প্রশাসনের স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের প্রশ্ন।
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নিজেদের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা ধরে রাখতে চায়, তবে “প্রশাসনিক কারণ” নামের এই অস্পষ্ট ব্যাখ্যার আড়ালে থাকা বাস্তব কারণগুলোও প্রকাশ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।