‘সরকার পরিবর্তনের পর অনেকেই দেশ ছাড়বেন’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে সেফ এক্সিট প্রসঙ্গ। বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সম্প্রতি এক বক্তব্যে দাবি করেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর সরকারের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন।
তার বক্তব্য অনুযায়ী, এই ব্যক্তিদের অধিকাংশই দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী অথবা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত। তিনি আরও ইঙ্গিত দেন যে, এদের মধ্যে অনেকে আগেই বিদেশে সম্পদ, ব্যবসা ও পরিবার গড়ে রেখেছেন—ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা না দেখিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পাড়ি জমাবেন।
রুমিন ফারহানা তার মন্তব্যে ২০০৭ সালের ‘ওয়ান ইলেভেন’ সময়কার ঘটনাগুলোর সঙ্গেও তুলনা টানেন। তার মতে,
“অতীতে ওয়ান ইলেভেনের সময় যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়ার অপকৌশল ব্যর্থ হয়েছিল, এবং যারা এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন তারা পরবর্তীতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন—এবারও সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হতে পারে।”
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে কিছু উপদেষ্টা এমন আছেন, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সুরক্ষার কথা চিন্তা করে ‘সেফ এক্সিট’-এর পথ খুঁজছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন অথবা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি নিয়েছেন।
রুমিন ফারহানা স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
“সরকারের প্রভাবশালী কিছু উপদেষ্টা আছেন, যারা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে কাজ করছেন। তারা আগস্টের পর তাদের বিদেশি পেশা ও জীবনে ফিরে যাবেন। তারা জানেন, এই পরিবর্তনের সময় বেশিদিন টিকবে না। তাই আগেই নিরাপদ প্রস্থান বা সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই, তাদের অনেকের সন্তান বিদেশে সেটেলড। তাই তারা যদি পরিস্থিতি অনুকূলে না পান, শেষ জীবনে বিদেশে গিয়ে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়াই তাদের বিকল্প হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে একটি বিতর্কিত বিষয়। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকরা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে থাকতে পারেন না, তবে পরামর্শক বা উপদেষ্টা পর্যায়ে তাদের সম্পৃক্ততা সরাসরি নিষিদ্ধ নয়। এই সুযোগের কারণেই বিদেশে বসবাসকারী কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।
রুমিন ফারহানার বক্তব্যে এই বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। তিনি দাবি করেছেন,
“দেশের জনগণের জীবনের ওপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এমন ব্যক্তিরা নিজেরাই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল।”
‘সেফ এক্সিট’ শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সংকটময় সময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিরাপদে ক্ষমতা বা দেশ ত্যাগের সুযোগ বোঝাতে। এটি সাধারণত সেই সব পরিস্থিতিতে দেখা যায়, যখন কোনো সরকার বা নেতৃত্ব জনগণের আস্থা হারায় এবং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান ইলেভেন পর্ব এই প্রসঙ্গের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় অনেক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ ছেড়েছিলেন। রুমিন ফারহানার বক্তব্যে বোঝা যায়, তিনি মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতিতেও অনেকে একই পথে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রুমিন ফারহানার মন্তব্য প্রকাশের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপির অনেক নেতা তার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, এটি “একটি বাস্তব চিত্র”। তাদের মতে, বর্তমান প্রশাসনের ভেতরে দুর্নীতি ও আত্মস্বার্থ এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে, পরিবর্তনের আভাস পেলেই অনেকেই বিদেশে পালানোর পরিকল্পনা করছেন।
অন্যদিকে, সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল তার বক্তব্যকে “রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। একজন সরকারি উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“এই ধরনের মন্তব্যের উদ্দেশ্য সরকারকে অস্থিতিশীল দেখানো। এখানে কোনো বাস্তবতা নেই। যারা কাজ করছেন, তারা দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্যই কাজ করছেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন,
“রুমিন ফারহানার বক্তব্যকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপস্থিতি দীর্ঘদিনের বিষয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় তারা আসলেই নিজেদের নিরাপদ রাখার পথ খোঁজেন।”
তিনি আরও বলেন,
“বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সদস্য যদি সত্যিই বিদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। জনগণের সামনে স্বচ্ছভাবে তাদের নাগরিক পরিচয় প্রকাশ করা উচিত।”
রুমিন ফারহানার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যারা দেশের নীতি নির্ধারণ করেন তারা যদি নিজেরাই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত থাকেন, তাহলে জনগণ কীভাবে তাদের প্রতি আস্থা রাখবে?
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন,
“আমরা যারা এখানে থেকে দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে চাই, তাদের নেতৃত্ব দেবেন এমন মানুষদের বিদেশে বাড়িঘর কেন? এটা কি দেশের প্রতি অবিশ্বাস নয়?”
রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রুমিন ফারহানার মন্তব্য শুধু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ নয়, বরং এটি সাম্প্রতিক কিছু অভ্যন্তরীণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা। বিএনপি ঘনিষ্ঠ কিছু সূত্রের দাবি, সরকারের ভেতরে থাকা কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা গত আগস্টে পরিবারসহ বিদেশ সফরে গিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থানান্তর, সম্পদ বিক্রি ও বিনিয়োগ পুনর্বিন্যাসের মতো কার্যক্রম চালিয়েছেন।
রুমিন ফারহানা নাম না করে বলেন,
“এদের অনেকেই ইতিমধ্যে বিদেশে স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করেছেন। তারা জানেন, এই সরকারের দিন ফুরোতে চলেছে।”
এই বক্তব্যের পর সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে সরকারের নৈতিক অবস্থান ও জবাবদিহিতা নিয়ে। রাজনৈতিক মহলের মতে, যদি সত্যিই সরকারের কিছু উপদেষ্টা বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দ্বৈত নাগরিক হন, তবে এটি কেবল নীতিগত নয়, আইনগতভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, কেউ একাধিক নাগরিকত্ব ধারণ করলে তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধ থাকবেন। তবে “উপদেষ্টা” পদটি সংবিধানের কাঠামোর বাইরে থাকায় এখানেই তৈরি হচ্ছে একটি আইনি ধূসর এলাকা, যা নিয়ে এখন রাজনৈতিক বিতর্ক তীব্র হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর সূত্রে জানা গেছে, রুমিন ফারহানার বক্তব্য দলীয় অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্প্রতি বিএনপির নীতিনির্ধারণী সভায়ও অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা, উপদেষ্টাদের নাগরিক পরিচয় ও আর্থিক দায়বদ্ধতা বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রস্তুতের প্রস্তাব তোলা হয়।
একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন,
“আমরা চাই জনগণ জানুক কারা এই সরকারের পেছনে আছেন, কারা বিদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। রুমিন ফারহানার বক্তব্য সেই সচেতনতা তৈরির অংশ।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ‘সেফ এক্সিট’ বিতর্কটি আসন্ন রাজনৈতিক সমীকরণে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে সরকার নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইবে, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো এই ইস্যুকে জনগণের সামনে তুলে ধরে নৈতিক বৈধতার প্রশ্ন তুলবে।
যদি উপদেষ্টাদের নাগরিকত্ব, বিদেশে সম্পদ বা পরিবার সংক্রান্ত প্রমাণ সামনে আসে, তবে এটি সরকারের জন্য বড় ধরনের জনমত সংকট তৈরি করতে পারে বলে ধারণা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
রুমিন ফারহানার মন্তব্য হয়তো তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে, কিন্তু এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো, নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা এবং দ্বৈত নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে “সেফ এক্সিট” এখন শুধু একটি ধারণা নয়, বরং তা ক্ষমতা, আস্থা ও নৈতিকতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ জানতে চায়—যারা দেশের নীতি নির্ধারণ করেন, তারা কি সত্যিই দেশের সঙ্গে থেকে জনগণের ভবিষ্যৎ ভাগ করবেন, নাকি পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেই অন্য কোথাও আশ্রয় নেবেন?