‘আগে যেমন জোর করে চাকরি দিতে পারতাম, এখন পারবো না’—সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যে তোলপাড়
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরের একটি ভিডিও বক্তব্য সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়—
“আগে যেমন জোর করে, ধাক্কাইয়া করতে পারছি, এখন পারবো না। এখন মিডিয়া অনেক স্ট্রং। নিজের যোগ্যতায় রিটেন পাস ও শারীরিক যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তারপর ভাইভাতে আমি ইনশাআল্লাহ সাহায্য করবো।”
চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে দেওয়া এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এটি কি অতীতের রাজনৈতিক প্রভাবের স্বীকারোক্তি, নাকি বর্তমান বাস্তবতায় যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব আরোপের আহ্বান?
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি গত জুলাই বা আগস্ট মাসে ধারণ করা হয়। ঘটনাটি ঘটে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার একটি মাদরাসায়, যেখানে লুৎফুজ্জামান বাবর স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে এক ঘরোয়া সভায় অংশ নিয়েছিলেন।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন—
- উপজেলা বিএনপির সভাপতি সেলিম কার্নায়েন,
- সাধারণ সম্পাদক গোলাম এরশাদুর রহমান,
- পৌর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম,
- পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী পুতুল,
এছাড়া আরও কয়েকজন স্থানীয় নেতাকর্মীও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বাবরের কাছে চাকরির বিষয়ে পরামর্শ চাইলে তিনি হেসে বলেন,
“আগে যেমন ধাক্কা দিয়ে দিতে পারতাম, এখন আর সেই সিস্টেম নাই। এখন মিডিয়া শক্তিশালী, সবাই দেখছে। আগে যেভাবে পারতাম, এখন সেভাবে পারবো না।”
বিষয়টি নিয়ে লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার সরাসরি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
তবে পৌর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ভিডিওটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন—
“আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি ঘরোয়া মিটিংয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেছেন। বিষয়টি কেউ বিকৃত করে ছড়িয়েছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, এখন আর সুপারিশে চাকরি পাওয়া যায় না—নিজের যোগ্যতায় প্রস্তুতি নিতে হবে।”
মোহনগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম এরশাদুর রহমান বলেন,
“বাবর সাহেবের বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের উৎসাহিত করা। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সময় বদলে গেছে। মিডিয়া এখন শক্তিশালী, তাই চাকরি পেতে হলে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।”
অন্যদিকে, কয়েকজন উপস্থিত ব্যক্তি জানান, বাবর দীর্ঘসময় পর এলাকায় এসে তরুণদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল না, বরং এটি ছিল বাস্তবতা স্বীকারের প্রকাশ।
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকে মনে করছেন, বাবরের বক্তব্য আসলে অতীতের রাজনৈতিক প্রভাবের স্বীকারোক্তি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জিয়াউর রহমান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন,
“লুৎফুজ্জামান বাবর এক সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ব্যাপক ক্ষমতাধর ছিলেন। তার বক্তব্যে হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই সময়ের প্রভাবিত প্রশাসনিক সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে। তবে তিনি যদি এখন যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দেন, সেটি ইতিবাচক পরিবর্তন।”
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগপন্থী এক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন—
“এই বক্তব্য প্রমাণ করে অতীতে রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে চাকরি বা প্রশাসনিক নিয়োগে হস্তক্ষেপ করা হতো। এখন মিডিয়া ও জনগণের নজরদারি বাড়ায় এমনটি আর সম্ভব নয়।”
বাবরের বক্তব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল “এখন মিডিয়া অনেক স্ট্রং”।
রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, এটি বর্তমান সময়ের বাস্তব প্রতিফলন।
বাংলাদেশে গত দুই দশকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রশাসন, নিয়োগ প্রক্রিয়া কিংবা দুর্নীতির বিষয়গুলো এখন আর সহজে গোপন রাখা সম্ভব নয়।
একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন,
“যারা আগে রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেক কিছু করতে পারতেন, এখন তারা জানেন—একটি ভিডিও বা একটি স্ট্যাটাসেই সবকিছু ভাইরাল হয়ে যায়। বাবরের বক্তব্য এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করছে।”
বাবরের বক্তব্যে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রতিক্রিয়াও এসেছে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে।
চট্টগ্রামের এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. রিয়াজুল করিম বলেন,
“তিনি যেভাবে বলেছেন, তাতে বোঝা যায় এখন যোগ্যতার প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এটা ভালো দিক। কিন্তু আগে যদি ধাক্কা দিয়ে চাকরি দিতেন, তাহলে তা অন্যায় ছিল। এখনই সময় সবকিছু স্বচ্ছ করার।”
অন্যদিকে, নেত্রকোনার স্থানীয় এক তরুণ বলেন,
“বাবর ভাই শুধু বাস্তব কথা বলেছেন। এখন সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়। রাজনীতি দিয়ে সবকিছু হয় না।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি, প্রশাসন ও রাজনীতির সম্পর্ক একটি আলোচিত বিষয়।
অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন সরকার আমলে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা কখনও কখনও নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বাবরের বক্তব্য আসলে সেই প্রথারই “শেষ অধ্যায়ের প্রতিফলন।”
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. নাসরিন হোসেন বলেন,
“বাবরের বক্তব্য একধরনের সততা। তিনি স্বীকার করছেন, এখন আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো যায় না। এটি একদিকে ইতিবাচক, অন্যদিকে আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তার প্রমাণ।”
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো—রাজনীতিবিদদের প্রতিটি বক্তব্য এখন মিডিয়া ও জনগণের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে।
একটি ঘরোয়া সভায় দেওয়া বক্তব্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
ডিজিটাল যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সালমান চৌধুরী বলেন,
“এখন রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে—‘অফ দ্য রেকর্ড’ বলে কিছু আর নেই। একটি মোবাইল ক্যামেরাই সংবাদ হতে পারে। তাই বক্তব্যের আগে ভাবতে হবে।”
লুৎফুজ্জামান বাবর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময় আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
তিনি বিএনপি সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার হন।
এরপর দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি আবারও সক্রিয় হয়েছেন। ভাইরাল ভিডিওটি তার সেই পুনরাবির্ভাবের সময়েই ছড়িয়েছে, যা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নেত্রকোনার স্থানীয় বিএনপি নেতারা এই ভিডিওকে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ বলে দাবি করেছেন।
তাদের ভাষায়, এটি কোনো বিতর্কিত বক্তব্য নয়; বরং এটি ছিল একটি বাস্তবমুখী উপদেশ।
একজন স্থানীয় নেতা বলেন,
“তিনি সবসময়ই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেন। এ বক্তব্যেরও সেই উদ্দেশ্য। কিন্তু অনেকে রাজনৈতিকভাবে তা বিকৃতভাবে ছড়িয়েছে।”
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগপন্থী স্থানীয় নেতারা বলছেন,
“বাবরের মুখেই তার স্বীকারোক্তি এসেছে—আগে তারা প্রভাব খাটিয়ে চাকরি দিতেন। জনগণ এখন সেটিই বুঝছে।”
রাজনৈতিক নৈতিকতা নিয়ে গবেষক ড. ইমরান হাবিব বলেন,
“এই বক্তব্য যদি সত্যিই বাবরের নিজের উপলব্ধি থেকে আসে, তাহলে এটি একটি নৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কারণ একজন প্রাক্তন প্রভাবশালী নেতা স্বীকার করছেন, এখন মিডিয়া ও জনগণ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।”
তিনি আরও বলেন,
“এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য—যখন ক্ষমতার মানুষও বলে, ‘আগে যা পারতাম, এখন পারি না।’ এই সীমাবোধই সমাজকে উন্নত করে।”
লুৎফুজ্জামান বাবরের ভাইরাল ভিডিও হয়তো বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু এটি আমাদের সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতাও প্রকাশ করেছে।
চাকরি ও প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাবের যুগ শেষের দিকে, এখন সময় যোগ্যতার মূল্যায়নের।
বাবর যা বলেছেন, সেটি হয়তো আত্মসমালোচনার ফল, আবার হয়তো যুগের পরিবর্তনের বার্তা—
কিন্তু নিঃসন্দেহে, এই একটি বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণমাধ্যম, স্বচ্ছতা ও জননিরীক্ষার শক্তি কতটা বেড়েছে, তারই জীবন্ত উদাহরণ।