উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ, ফলাফলের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দিনভর উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তৈরি হয় বিরাট উৎসাহ ও উদ্দীপনা।
ভোটগ্রহণ শেষে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ভোট গণনা শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কার্যালয়ে, যেখানে প্রার্থীরা, এজেন্টরা ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ভোটগণনা সুষ্ঠুভাবে চলছে এবং দুই ধাপে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত একটি বড় নির্বাচনী আয়োজন। সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি অনুষদ ভবনে ভোটকেন্দ্রগুলোতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড়।
অনুষদভিত্তিক কেন্দ্রগুলো হলো—
- কলা অনুষদ
- বিজ্ঞান অনুষদ
- সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
- বাণিজ্য অনুষদ
- আইন অনুষদ
প্রতিটি কেন্দ্রে সকাল থেকেই শুরু হয় ভোটারদের লাইন। অনেক কেন্দ্রেই ব্যালটে ২৬টি পদে ভোট দিতে সময় বেশি লাগায় লম্বা লাইন তৈরি হয়, তবে ভোটারদের আগ্রহ ও শৃঙ্খলা ছিল চোখে পড়ার মতো।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. মনির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন,
“চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজ গণতান্ত্রিক চর্চার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।”
তিনি আরও জানান,
“এখন কেন্দ্রগুলো থেকে ব্যালট পৃথক করে ডিন কার্যালয়ে আনা হচ্ছে। সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটগণনা চলছে। ফলাফল দুই ধাপে ঘোষণা করা হবে।”
এবারের নির্বাচনে মোট ৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যার মধ্যে চাকসুতে ৪১৫ জন এবং হল সংসদে ৪৯৩ জন।
তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৭ জন, যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যার প্রায় পুরো অংশকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ছবি-সংযুক্ত ভোটার তালিকা থাকার কারণে জাল ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশ, আনসার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বাহিনী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছে।
দীর্ঘদিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল বিশেষ উচ্ছ্বাস। সকাল থেকেই দেখা গেছে পোস্টার, ব্যানার, মিছিল ও স্লোগানে মুখর পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবরিনা নওরিন বলেন,
“এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আবারও আমাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছি। যে প্রার্থী আমাদের অধিকার নিয়ে কাজ করবে, আমরা তাকেই ভোট দিয়েছি।”
অন্যদিকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মাহমুদ হাসান বলেন,
“চাকসু নির্বাচন মানে শুধু নেতৃত্ব নয়, এটি শিক্ষার্থীদের সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া। আমরা চাই এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা আরও প্রসারিত হোক।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, এবার নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পদক্ষেপ।
প্রতিটি কেন্দ্রে স্থাপন করা হয় সিসিটিভি ক্যামেরা, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২৪ ঘণ্টা টহল দিয়েছে ক্যাম্পাসে।
চবি প্রক্টর ড. নূর মোহাম্মদ বলেন,
“আমরা শুরু থেকেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। কোনো ধরণের নাশকতা বা বিশৃঙ্খলা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে আমরা কঠোর নজরদারিতে ছিলাম।”
তিনি আরও জানান,
“ছবি সংযুক্ত ভোটার তালিকা ও বিশেষ পাসধারী ভোটারদেরই প্রবেশের সুযোগ ছিল। ফলে পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম ঘটেনি।”
ভোটগ্রহণ শেষে বিকেল ৪টা থেকেই প্রার্থীরা ও তাদের সমর্থকরা জড়ো হতে থাকেন গণনা কেন্দ্রের সামনে।
ডিন কার্যালয়ের বাইরে ও ভেতরে টানটান উত্তেজনা, কেউ কেউ মোবাইল ফোনে ব্যালট গুনে রাখছেন, কেউ আবার ফেসবুকে লাইভে জানাচ্ছেন ভোট গণনার অগ্রগতি।
সাংবাদিকদের সামনে ব্যালট গণনার প্রক্রিয়া শুরু হয় বিকেল ৫টার দিকে। ভোটগণনার সময় প্রত্যেক প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া একাধিক সংগঠন ও প্যানেল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
“চবি সাধারণ ছাত্র ফোরাম”-এর প্রার্থী রাকিবুল ইসলাম রুবেল বলেন,
“এবারের নির্বাচন প্রশাসনের ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে সত্যিই স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণই তার প্রমাণ।”
এদিকে, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের এক নেত্রী বলেন,
“আমরা চাই ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকুক। চাকসু হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মঞ্চ।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এবার ফলাফল দুই ধাপে ঘোষণা করা হবে।
প্রথম ধাপে ঘোষণা করা হবে হল সংসদের ফলাফল, এরপর রাতে বা পরদিন সকালে ঘোষণা করা হবে চাকসুর পূর্ণাঙ্গ ফলাফল।
ফলাফল প্রকাশের পর বিজয়ী প্রার্থীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচন সবসময়ই বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৭০-এর দশক থেকে চাকসু নেতৃত্ব দিয়েছে অসংখ্য জাতীয় নেতা, যারা পরে দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব রেখেছেন।
দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন তাই শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু একটি ভোট নয়, বরং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চবির সাবেক শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শাহেদুর রহমান বলেন,
“চাকসু নির্বাচন মানে কেবল প্রার্থীদের জয় বা পরাজয় নয়, বরং এটি একটি প্রক্রিয়া—যেখানে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি শেখে, নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। দীর্ঘ বিরতির পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিজেই একটি ইতিবাচক বার্তা।”
ভোট দিতে আসা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই জানিয়েছেন, তারা এমন নেতৃত্ব চান যারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করবে এবং প্রশাসনের সঙ্গে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে।
এক ভোটার বলেন,
“আমরা চাই চাকসু রাজনীতি হোক শিক্ষার্থীদের কল্যাণকেন্দ্রিক। অতীতে যেমন দখল-দুর্নীতি বা সহিংসতা ছিল, তা আর যেন না ফিরে আসে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজও আশা প্রকাশ করেছেন, নতুন নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশে শান্তি, একাডেমিক অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন পর এমন নির্বাচন আয়োজন করায় ইউনেস্কো ও এশিয়ান স্টুডেন্ট ইউনিয়ন থেকেও প্রশংসা এসেছে।
তারা এক বিবৃতিতে বলেছে,
“দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষার্থী নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক চর্চা পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ একটি দৃষ্টান্ত।”
যদিও আনুষ্ঠানিক ফলাফল এখনো ঘোষণা হয়নি, তবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে,
স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তরুণ সংগঠনগুলো এবারও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,
“চবি চাকসু নির্বাচন ভবিষ্যতে জাতীয় ছাত্ররাজনীতির দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখান থেকে উদীয়মান নেতারা একদিন জাতীয় রাজনীতিতেও আসবেন।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, তরুণ প্রজন্ম গণতন্ত্রের মূল্য বোঝে, অংশগ্রহণে বিশ্বাস করে এবং পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।
ভোটগ্রহণের দিনজুড়ে শিক্ষার্থীদের চোখে যে আলো ও আশার প্রতিফলন দেখা গেছে, সেটিই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রাজনীতির পথ দেখাবে।
এখন অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার— কে জিতল, কে হারল, তা যতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবারও দেখাল, গণতন্ত্রকে চর্চা করেই বাঁচিয়ে রাখা যায়।