গাজায় মিনারবিহীন সকাল: ইসরায়েলি হামলায় ইতিহাস হারাচ্ছে মসজিদসমূহ
ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে শতাব্দীপ্রাচীন ইসলামি ঐতিহ্য। পাথরের দেয়ালে খোদিত ইতিহাস, মিনার থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি—সবকিছু এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ। যুদ্ধ, বোমা আর আগ্রাসনের আগুনে আজ ধ্বংস হয়ে গেছে গাজার অধিকাংশ মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনা।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান এই গণহত্যামূলক অভিযানে ইসরায়েল এমনভাবে গাজার অবকাঠামো ধ্বংস করেছে যে, এখন উপত্যকার আকাশে আর ভেসে ওঠে না মিনারের ছায়া।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে ইসরায়েলি বাহিনী উপত্যকার মোট ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে অন্তত ৮৩৫টি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে এবং আরও ১৮০টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই মসজিদগুলোর মধ্যে বহু প্রাচীন অটোমান ও মামলুক যুগের স্থাপত্য ছিল, যেগুলোর বয়স সাত শতাব্দীরও বেশি। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এই নিদর্শনগুলো আজ পরিণত হয়েছে ধুলো ও পাথরের স্তূপে।
গাজার শুজাইয়্যা অঞ্চলের বাসিন্দা আবু খালেদ আল-নাজ্জার নিজের চোখে দেখেছেন ইবনে ওসমান মসজিদের ধ্বংস। সেখানে তিনি শৈশব থেকেই নামাজ আদায় করতেন। এখন সেই মসজিদের স্থানে শুধু ধ্বংসস্তূপ।
তিনি কণ্ঠ ভারী করে বলেন,
“আমার বাবার কণ্ঠস্বর চিনার আগেই আমি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ চিনতাম। এখন নামাজের গালিচাটাও ধুলোর নিচে চাপা পড়ে গেছে। কখনো ভাবিনি এমন এক দিন আসবে, যখন আমরা মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়ব।”
গাজার পুরাতন শহরের অন্যতম প্রতীক গ্রেট ওমারি মসজিদ ছিল ইসলামি স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। শত শত বছর ধরে এখানে নামাজ পড়া, কুরআন শিক্ষা, বিয়ে ও জানাজার মতো নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড চলত।
কিন্তু এখন সেই জায়গায় শুধু ধ্বংসাবশেষ।
মাহমুদ কান্দিল, ২৭ বছর বয়সী এক স্থানীয় যুবক, কিবলা দেয়ালের পাথর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তার ভাষায়,
“এই মসজিদটি ছিল গাজার প্রাণকেন্দ্র। মামলুক যুগের মার্বেল স্তম্ভগুলো আর নেই। তারা শুধু ভবন ধ্বংস করেনি, গাজার স্মৃতি মুছে ফেলেছে।”
গাজার আল-দারাজ পাড়ায় একসময় ছিল ঐতিহাসিক আল-সাইয়্যিদ হাশিম মসজিদ, যেখানে বিশ্বাস করা হয় নবী মুহাম্মদের (সা.) নানা হাশিম ইবনে আবদ মানাফ সমাহিত আছেন।
এখন সেই স্থানে পড়ে আছে ধসে যাওয়া সবুজ গম্বুজ ও ভাঙা দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ।
৭৪ বছর বয়সী উম্মে ওয়ায়েল, যিনি প্রতি বৃহস্পতিবার মসজিদে সূরা আল-কাহফ পড়তে যেতেন, বলেন—
“এখন মসজিদ নেই, কিন্তু আমরা ঘর থেকে কুরআন পড়ি। আল্লাহ আমাদের কণ্ঠ শুনেন, দেয়াল ভাঙলেও বিশ্বাস ভাঙে না।”
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকাও বাদ যায়নি ইসরায়েলি হামলা থেকে। ৪৫ বছর বয়সী আবদুর রহমান আল-সাত্রি জানান, তাদের এলাকার মসজিদ শুধু নামাজের জায়গা ছিল না; এটি ছিল সমাজের মিলনমেলা, একটি কেন্দ্র যেখানে ছিল লাইব্রেরি, পাঠচক্র, বিবাহ ও জানাজার আয়োজন।
তিনি বলেন,
“তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে— যেন আমাদের আত্মাটাকেই মেরে ফেলতে চায়।”
গাজাভিত্তিক ইসলামিক ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ জুহা বলেন, এটি কেবল যুদ্ধ নয়— এটি একটি সাংস্কৃতিক গণহত্যা।
তার মতে,
“ইসরায়েল শুধু মসজিদ ধ্বংস করছে না; তারা ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় স্মৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। মিনারগুলো শহরের প্রতীক ছিল, এখন সেগুলো কেবল মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, ইতিহাস মুছে ফেলার এই প্রক্রিয়া পরিকল্পিত। এটি দেখায় যে, দখলদার শক্তি কেবল ভূমি দখলেই সীমাবদ্ধ নয়— তারা সংস্কৃতি ও বিশ্বাসও দখল করতে চায়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এত ধ্বংসের পরও আজানের ধ্বনি থেমে যায়নি গাজায়। বিধ্বস্ত ভবনের ছাদে, ধসে পড়া মসজিদের ধ্বংসাবশেষে, যুবকেরা ব্যাটারিচালিত লাউডস্পিকারে আজান দিচ্ছেন।
সন্ধ্যার সময় মানুষ ভাঙা দেয়ালের কোণে পুরনো মাদুর বিছিয়ে নামাজ পড়ছেন।
এই দৃশ্য যেন ইঙ্গিত দেয়— ধ্বংসের ভেতরেও বিশ্বাসের আলো টিকে আছে। গাজা এখন কেবল এক যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এটি মুসলমানদের ধৈর্য, স্থিতি ও ঈমানের প্রতীক।
গাজার এই সাংস্কৃতিক ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় আজও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নিন্দা বিবৃতি থাকলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে মসজিদ ধ্বংস শুধু সামরিক অভিযান নয়, এটি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের সময় ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করা যুদ্ধাপরাধের শামিল। কিন্তু ইসরায়েল বারবার সেই সীমা অতিক্রম করছে এবং বিশ্ব নীরব দর্শক।
গাজার মানুষ শুধু অস্ত্র নয়, তাদের ঈমান ও সংস্কৃতির মাধ্যমেও প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।
প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ এখন এক একটি প্রতীক—যেখানে মানুষ নতুন করে গড়ে তোলে প্রার্থনার স্থান, বাচ্চাদের শেখায় কুরআনের আয়াত, আর ধ্বংসের মধ্যেই খুঁজে নেয় জীবন।
আবু খালেদ আল-নাজ্জার বলেন,
“আমরা যখন ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ি, তখন মনে হয়, এই ভূমি এখনো আল্লাহর ঘর। যত মসজিদ ধ্বংস হোক, আমাদের ঈমান ধ্বংস হবে না।”
বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা গাজার মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় ক্ষোভ ও শোক প্রকাশ করেছেন। তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে—
“গাজায় মসজিদ ধ্বংস কেবল ইসলাম নয়, মানবতার ওপরও আঘাত।”
যুদ্ধের দুই বছরে গাজার শিশুরা শুধু বোমা, ধ্বংস ও মৃত্যুই দেখেছে। তাদের ইতিহাস শেখার জায়গাগুলো, মসজিদের লাইব্রেরিগুলো, ধর্মীয় পাঠাগার—সবই হারিয়ে গেছে।
গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই প্রজন্মের কাছে ফিলিস্তিনি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের চিহ্ন বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তবু আশার আলো একটাই— প্রতিটি পরিবার এখন নিজ ঘরকেই ছোট্ট মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। সেখানেই শেখানো হচ্ছে নামাজ, কুরআন ও ইসলামি ইতিহাস।
গাজা উপত্যকার ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদগুলো আজ বিশ্বের কাছে এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে— কত ধ্বংস হলে মানবতা জেগে উঠবে?
যেখানে প্রতিটি বোমা মাটির নিচে চাপা দিচ্ছে শতাব্দীর ইতিহাস, সেখানে গাজার মানুষ প্রতিদিন প্রমাণ করছে— বিশ্বাস ধ্বংস করা যায় না।