তদন্তে নতুন মোড়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজর সীমান্ত ও রাজধানীতে
চাঞ্চল্যকর এক ঘটনায় দেশের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল কবির আহমেদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত তিন দিন ধরে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে তাঁর পরিবার। এ ঘটনায় শুধু প্রতিরক্ষা মহল নয়, রাজনৈতিক অঙ্গন ও প্রশাসনেও চরম উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত বুধবার সকালে তিনি নিজ বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হন। এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর বারিধারা এলাকায় শেষবার তাঁর গাড়িটি দেখা গেছে।
নিখোঁজ মেজর জেনারেল কবির আহমেদের স্ত্রী ফারজানা কবির বলেন,
“আমার স্বামী অত্যন্ত নিয়মিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষ। কোনো নোটিশ ছাড়াই তিনি বাইরে থাকেন না। বুধবার সকালে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বের হন, কিন্তু তারপর আর কোনো খোঁজ পাইনি। ফোনও বন্ধ, সহকর্মীরাও জানে না তিনি কোথায়।”
তিনি আরও বলেন, পরিবার থেকে ইতোমধ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে এবং সামরিক কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“মেজর জেনারেল কবির একজন অভিজ্ঞ অফিসার। তিনি সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আমাদের জন্যও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।”
আইএসপিআরের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিখোঁজ ঘটনার বিষয়ে সেনা গোয়েন্দা বিভাগ, পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা একযোগে তদন্ত করছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানান,
“আমরা মেজর জেনারেল কবিরের ফোনের সর্বশেষ লোকেশন ট্রেস করার চেষ্টা করছি। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর গাড়িচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বারিধারার একটি রাস্তার মোড়ে কবির স্যার তাঁকে গাড়ি থামাতে বলেন এবং সেখানেই নামেন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।”
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ঘটনাটি নিছক নিখোঁজ নয়—এখানে কোনো ‘পরিকল্পিত গোপন অপারেশন’ বা ‘ব্যক্তিগত নিরাপত্তাজনিত কারণ’ থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ মুখ খুলছে না।
সেনাবাহিনীর একজন মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাত মেজর জেনারেল কবির আহমেদ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থায়ও দায়িত্বে ছিলেন।
কয়েক মাস আগে তাঁকে রাজধানীতে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই প্রকল্পে সরকারি অর্থ বরাদ্দ, আন্তর্জাতিক দরপত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে অনেকেই মনে করছেন, তাঁর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে প্রশাসনিক বা আর্থিক কোনো জটিলতা থাকতে পারে।
নিখোঁজের ঘটনাটি প্রকাশিত হতেই দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিরোধী দল বিএনপি এক বিবৃতিতে বলেছে,
“দেশে যখন আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন এমন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নিখোঁজ হওয়া উদ্বেগজনক। এটি প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও এখন অনিশ্চিত।”
অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের এক মুখপাত্র বলেছেন,
“মেজর জেনারেল কবিরের নিখোঁজের বিষয়টি সরকার গুরুত্বসহকারে দেখছে। এটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,
“এই ঘটনা নিছক একজন ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়া নয়; এটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ও জনআস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করা না যায়, তাহলে এটি জাতীয় মনোবলে প্রভাব ফেলবে।”
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, মেজর জেনারেল কবিরের মোবাইল ফোন সর্বশেষ শনাক্ত হয়েছে টঙ্গী-গাজীপুর সড়কের এক এলাকায়। এরপর থেকে ফোনের কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি। শুক্রবার রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি টিম সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও অভিযান চালিয়েছে।
এক কর্মকর্তা জানান,
“আমরা নিশ্চিত নই, তিনি নিজে কোথাও চলে গেছেন, নাকি অপহৃত হয়েছেন। তবে তাঁর গাড়ি বা ফোনের কোনো সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, তিনি একটি কালো গাড়িতে উঠছেন।”
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কবির আহমেদের সহকর্মী কয়েকজন বিদেশি কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’ ও ‘বিবিসি বাংলা’ বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ঢাকা অফিস থেকে বলা হয়েছে,
“যে কোনো নাগরিক—বিশেষ করে রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—নিখোঁজ হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর উদাহরণ। আমরা সরকারের কাছে অবিলম্বে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।”
মেজর জেনারেল কবিরের এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বলেন,
“তিনি খুবই নীতিবান ও সাহসী অফিসার ছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি ও সিদ্ধান্তে তিনি স্বচ্ছতার পক্ষপাতী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি কিছু অনিয়ম নিয়ে উচ্চপর্যায়ে মন্তব্য করেছিলেন বলেও শুনেছি। তবে সেটি এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, তা বলা যাচ্ছে না।”
পরিবারের সদস্যরা আশঙ্কা করছেন, কবির আহমেদ হয়তো কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তাঁর ছেলে জানায়,
“বাবা কখনো কোনো হুমকি পেয়েছেন কি না, তা আমরা জানি না। তবে তিনি সবসময় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এখন শুধু তাঁর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন চাই।”
সরকারি প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মেজর জেনারেল কবির নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দপ্তরে নীরবতা নেমে এসেছে। কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেনি, তবে অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
“এই ঘটনাটি সংবেদনশীল পর্যায়ের। কারণ তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তাই তদন্তের স্বার্থে আমরা খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করছি না।”
ঘটনার পর থেকেই ফেসবুক, এক্স (টুইটার) এবং ইউটিউব জুড়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। কেউ বলছেন, এটি অপহরণ, কেউ বলছেন, তিনি আত্মগোপনে গেছেন কোনো গোপন মিশনের কারণে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্লেষক সাদিয়া রহমান বলেন,
“এখন অনলাইনে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই সরকার ও সেনাবাহিনীর উচিত নির্ভরযোগ্য আপডেট দেওয়া, যাতে গুজব বন্ধ হয়।”
হাজারীবাগ, বারিধারা, বনানী ও আশপাশের এলাকাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। পাশাপাশি, র্যাবের একটি বিশেষ টিম তাঁর সর্বশেষ মোবাইল ট্রানজেকশন ও ইমেল যোগাযোগ বিশ্লেষণ করছে।
একজন র্যাব কর্মকর্তা জানান,
“আমরা সব দিক খতিয়ে দেখছি—ব্যক্তিগত, পেশাগত ও পারিবারিক। এখন পর্যন্ত কোনো মুক্তিপণ দাবি বা রাজনৈতিক বার্তা পাওয়া যায়নি, যা ইঙ্গিত দেয় এটি পরিকল্পিত নিখোঁজ।”
রাজধানীর সাধারণ মানুষও এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন। অনেকেই বলছেন,
“যদি একজন মেজর জেনারেল নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা কোথায়?”
বিশেষ করে সামরিক পরিবারের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর ফেরার দাবি জানাচ্ছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) মাহবুবুল ইসলাম বলেন,
“যদি এটি অপহরণ হয়, তাহলে এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত। আবার যদি তিনি স্বেচ্ছায় কোথাও চলে যান, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন—কেন এমন করলেন?”
তিনি আরও বলেন,
“এই ঘটনার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার সমন্বয় ঘাটতি স্পষ্ট হচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
এখন পর্যন্ত মেজর জেনারেল কবির আহমেদ কোথায় আছেন, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে সময় যত গড়াচ্ছে, ততই জনমনে শঙ্কা বাড়ছে।