ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া নতুন সামরিক চুক্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ এই সমঝোতাকে মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য একটি ‘ইসলামী ন্যাটোর’ ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারক ও কৌশলবিদদের কাছে এটি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক বড় ‘বিপদ সংকেত’ হয়ে দেখা দিয়েছে।
চুক্তিটিকে শুধু সামরিক নয়, বরং কৌশলগত এক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌদি ও পাকিস্তানের এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করলেও, ইসলামাবাদ ও রিয়াদের এই জোট তার সব প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মোদির আরব কূটনীতির ব্যর্থতা
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে সচেষ্ট ছিলেন। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন—সব দেশেই একাধিকবার সফর করেছেন তিনি। লক্ষ্য ছিল, ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করা। কিন্তু এত কূটনৈতিক বিনিয়োগ সত্ত্বেও রিয়াদ-ইসলামাবাদ সামরিক চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ায় নয়াদিল্লির পররাষ্ট্রনীতি কার্যত ব্যর্থতার মুখে পড়েছে।
অনেকে এই পরিস্থিতিকে ভারতের গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, সৌদি ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে গোপনে একটি সামরিক জোটের পরিকল্পনা করছিল, অথচ নয়াদিল্লির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সে বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। ফলে আগেভাগে কোনো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ বা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেনি ভারত।
ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ
সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মতে, এই চুক্তির ফলে ভারতের জন্য নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের মাটিতে কোনো ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো সীমান্ত পার অভিযান চালাতে হলে এখন ভারতকে দুইবার ভাবতে হবে। কারণ, সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী সৌদি আরব পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে—যা কার্যত ভারতের জন্য দ্বিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করছে।
অন্যদিকে কাশ্মীর ও সিন্ধু চুক্তি নিয়ে চলমান উত্তেজনা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করছে। সম্প্রতি ভারত সিন্ধু নদ চুক্তি স্থগিত করেছে, যার জেরে ইসলামাবাদ পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছে একাধিকবার। গুজরাটের কচ্ছের রণ এলাকা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিবাদ চলমান।
২০১৮ সালে পাকিস্তান সরকার হঠাৎ নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে যেখানে স্যার ক্রিক ও জুনাগড় অঞ্চলকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখানো হয়। একইসঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক ঘাঁটি বাড়াতে শুরু করেছে ইসলামাবাদ। এসব ইঙ্গিত স্পষ্ট করছে, দক্ষিণ এশিয়া নতুন করে অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে।
সৌদির আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার পাকিস্তানের হাতে
চুক্তি অনুসারে, প্রয়োজনে সৌদি আরব পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে। বর্তমানে সৌদি বিমানবাহিনীর বহরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি F-15 ফাইটার জেট এবং ইউরোপীয় যৌথ উদ্যোগে তৈরি ইউরোফাইটার টাইফুন। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই জেটগুলো পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হলে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য বদলে যেতে পারে।
এছাড়া জ্বালানি খাতে ভারতের ওপরও বড় চাপ তৈরি করতে পারে সৌদি। বর্তমানে ভারতের ৮৫ শতাংশ তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, যার বড় অংশই আসে সৌদি আরব থেকে। ফলে এই সামরিক চুক্তি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, জ্বালানি নির্ভরতার ক্ষেত্রেও নয়াদিল্লির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
অতীতের ইতিহাসে সম্ভাব্য পুনরাবৃত্তি
বিশ্লেষকরা ১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সে সময় পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের পাশে দাঁড়ানোয় আরব দেশগুলো ইউরোপে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে বিশ্বজুড়ে মারাত্মক জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সৌদি ও পাকিস্তানের জোটের কারণে তেমন পরিস্থিতি ফের সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ইসলামী ন্যাটো গঠনের সম্ভাবনা
চুক্তির পর থেকেই পাকিস্তান অন্য মুসলিম দেশগুলোকে একই ধরনের সামরিক সমঝোতায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ইসলামাবাদ এমনকি মুসলিম দেশগুলোকে ‘পারমাণবিক সুরক্ষা’ দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। যদি ৫৭টি মুসলিম দেশ যৌথভাবে এমন কোনো সামরিক জোট গঠন করে, তবে তা কার্যত এক ‘ইসলামী ন্যাটো’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
এই জোট গঠিত হলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কৌশলগত অবস্থান যে কঠিন চাপে পড়বে, তা স্পষ্ট। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যেতে পারে এবং ইসরাইলের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
অর্থনৈতিক দিক ও ভারতের সম্ভাব্য সংকট
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০২৫-২৬ অর্থবছরে হাজার কোটি ডলার, সৌদি আরবের প্রায় ৭ হাজার কোটি ডলার, আর ভারতের ৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। দুই দেশের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যয় ভারতের কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে নয়াদিল্লির জন্য এটি একটি উদ্বেগজনক সংকেত।
অন্যদিকে সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ৯০ লাখ ভারতীয় প্রবাসীও এখন সম্ভাব্য চাপে রয়েছেন। ইসলামাবাদ চাইলে রিয়াদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের কর্মসংস্থানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী দেশে ফিরে এলে ভারতের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা অনস্বীকার্য।
মোদির সামনে কঠিন কূটনৈতিক সমীকরণ
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের জন্য ন্যাটো ধাঁচের কোনো সামরিক চুক্তিতে যুক্ত হওয়া এখনো কঠিন। ইসরাইলের সঙ্গে জোট করলে আরব বিশ্বের বিরাগভাজন হতে পারে নয়াদিল্লি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করলে ভারতের মাটিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতির প্রশ্ন উঠতে পারে।
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করলেও ইউক্রেন সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে জটিলতা সৃষ্টি হবে। তাই মোদি সরকার আপাতত ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশলকে দুর্বল করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাণিজ্য সম্পর্ক: সৌদির জন্য দ্বিমুখী বাস্তবতা
তবে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, সৌদি আরব সহজে ভারতবিরোধী অবস্থান নেবে না। কারণ, বর্তমানে ভারত সৌদির চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ১৮৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদির বাণিজ্যিক সম্পর্ক মাত্র ৩০০-৪০০ কোটি ডলার পর্যন্ত সীমিত।
অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা দিতে হয় ইসলামাবাদকে, যা রিয়াদের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। ফলে সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি যতই সামরিক হোক না কেন, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সৌদি আরব ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করবে—এমন সম্ভাবনা কম।
চুক্তির নেপথ্যে ইসরাইলবিরোধী সমীকরণ
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর দাবি, এই চুক্তির পেছনে আরব দেশগুলোর আরেকটি উদ্দেশ্য রয়েছে—ইসরাইলবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের দোহায় ইসরাইলি হামলার পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও তিউনিসিয়ায় একযোগে হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। ঠিক এর পরপরই ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কোনো এক পক্ষ আক্রান্ত হলে অন্য পক্ষ তা নিজেদের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করবে—যা কার্যত যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির আকার ধারণ করেছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি-পাকিস্তান সামরিক চুক্তিকে হালকাভাবে নিলে বড় ভুল হবে। কারণ, এর মাধ্যমে ইসলামাবাদ শুধু কৌশলগত অবস্থানই শক্ত করছে না, বরং আরব দুনিয়ায় নিজেদের ‘পারমাণবিক নেতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত যদি দ্রুত কূটনৈতিকভাবে সাড়া না দেয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য এক নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। অনেকেই তাই ভারতের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন—ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার সঙ্গে সীমিত সামরিক সহযোগিতার চুক্তি করে অন্তত প্রতিরক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখতে।