ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের চেষ্টার অভিযোগ উঠে এসেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতের সংকোচন, অবহেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক দমননীতির কারণে ইবতেদায়ি ও দাখিল মাদরাসাগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে পড়ে। তবে জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন করে আশার আলো দেখছে দেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক “সকলের কণ্ঠ”–কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের সময় মাদরাসা শিক্ষা বন্ধের দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রথমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ইবতেদায়ি মাদরাসার বিকল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। পরে এসব স্কুল সরকারি করা হলেও ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো অবহেলিত থেকে পড়ে, কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়ে একে একে বন্ধ হয়ে যায়। এতে হাজারো শিক্ষক-পারিচালক জীবিকা হারান, অনেক মাদরাসার জায়গায় গড়ে ওঠে খেলার মাঠ বা বাজার। তিনি জানান, শেখ হাসিনা সরকারের সময় মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডকে চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয় নতুন কোনো ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাদরাসা পর্যায়ের শিক্ষা বন্ধ করা, যাতে শিক্ষার্থী না পেয়ে দাখিল, আলিম ও ফাজিল স্তরও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। তবে তিনি জানান, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ অবস্থার আমূল পরিবর্তনে পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের প্রথম ধাপে এক হাজার ৯০টি অনুদানভুক্ত ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিওভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর বাইরে আরো আড়াইশর বেশি মাদরাসা যাচাই-বাছাইয়ের পর এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় আছে। পাশাপাশি যেসব মাদরাসা এখনো কোডবিহীন, সেগুলোকেও যাচাই করে নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, “এক সময় শিক্ষকরা মাসে মাত্র তিন হাজার টাকা পেতেন, যা একজন ভিক্ষুকের আয়ের চেয়েও কম। কিন্তু এখন এমপিওভুক্ত হলে তাদের জীবনে পরিবর্তন আসবে।” দেশের মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করছে জানিয়ে অধ্যাপক নূরুল হক বলেন, প্রতি জেলায় একটি করে মাদরাসা সরকারিকরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে সরকারি মাদরাসা মাত্র তিনটি—ঢাকা, সিলেট ও বগুড়া আলিয়া মাদরাসা। এ প্রস্তাবনাটি এখন প্রক্রিয়াধীন এবং বাস্তবায়িত হলে এটি হবে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাসে বড় একটি অর্জন। আওয়ামী লীগ আমলে মাদরাসা শিক্ষায় বৈষম্য, নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব এবং সনদধারীদের প্রতি বৈরিতার বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তার ভাষায়, “গত ১৫ বছরে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে চাকরি পায়নি। যারা পেয়েছিল, তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বসানো হয়েছিল।” বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায়ও মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে বঞ্চিত হতে হতো বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এ ছাড়া সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য মিড-ডে মিল ও উপবৃত্তি থাকলেও মাদরাসাগুলো এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল, ফলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রমেই কমে আসে। তিনি জানান, বর্তমান সরকার “স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন, পাঠদান, স্বীকৃতি, পরিচালনা ও জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা, ২০২৫” প্রণয়ন করেছে, যাতে নতুন করে মাদরাসা স্থাপন ও অনুমোদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে মাদরাসা বোর্ডে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে শিক্ষা ক্যাডার থেকে মাদরাসাবিদ্বেষী কর্মকর্তারা ডেপুটেশনে আসতেন, এখন সেখানে ১২টি পদের মধ্যে ৯টিতে মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তারা নিয়োজিত। নূরুল হক বলেন, “আগে আলেম-ওলামাদের হেনস্তা করা হতো, তাদের নাজেহাল করে কর্মকর্তারা বিকৃত আনন্দ পেতেন। এখন সেই সময়ের অবসান ঘটেছে।” তিনি জানান, তার অফিস এখন সবার জন্য উন্মুক্ত, যে কেউ দেখা করতে পারে, এবং সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান না হলেও তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যবইয়ে বিকৃতি ও অপতথ্যের বিষয়েও সংশোধন আনা হয়েছে। তিনি বলেন, “আগামী শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা যে বইগুলো পাবে, সেগুলোতে বিগত সময়ের সব আপত্তিকর বয়ান বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের বইয়ে ভুল কিছু থাকবে না এবং ২০২৭ সালে পুরোপুরি নতুন বই প্রকাশিত হবে।” তিনি আরও জানান, আওয়ামী শাসনামলে সাধারণ বিষয়ের আধিক্য বাড়িয়ে মূল ধর্মীয় বিষয়—আরবি, কোরআন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি—কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নম্বর আরবি বিষয়ের জন্য বরাদ্দ থাকবে, বাকি অংশ সাধারণ বিষয়ের জন্য। মাদরাসা শিক্ষায় মানোন্নয়নেও বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। এমপিওভুক্ত মাদরাসাগুলোর শিক্ষকদের স্ট্যাম্পে অঙ্গীকার নেওয়া হচ্ছে যে, তারা শিক্ষার মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।” এ ছাড়া নন-এমপিও মাদরাসাগুলোকেও নিজস্ব প্যাডে লিখিত অঙ্গীকার দিতে বলা হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের পেশাগত দিগন্ত উন্মুক্ত করবে। শিক্ষকের মানোন্নয়নের প্রসঙ্গেও তিনি বলেন, “আগের আমলে যোগ্যতা বিবেচনা না করে পক্ষপাতমূলক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এখন আমরা তাদের নিজ উদ্যোগে দক্ষতা বাড়াতে উৎসাহ দিচ্ছি।” মাদরাসা থেকে শিক্ষার্থী স্কুলে চলে যাওয়ার প্রবণতা কমছে বলেও জানান তিনি। ২০২৫ সালের দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী এবং আলিমে অংশ নিয়েছে ৮৬ হাজারের বেশি। ইতিমধ্যে দেড় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী আলিমে ভর্তি হয়েছে, যা আস্থার পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়। সবশেষে অধ্যাপক নূরুল হক বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া নয়, বরং মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক, কর্মমুখী ও সমাজবান্ধব রূপে গড়ে তোলা। এতে ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি দক্ষতা ও পেশাগত জ্ঞান অর্জন করবে শিক্ষার্থীরা।”