রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের টানাপোড়েনে অচলাবস্থার মুখে মার্কিন প্রশাসন
যুক্তরাষ্ট্রে আবারও সরকারি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান দল ও বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা যৌথ বাজেট বিল নিয়ে একমত হতে না পারলে আগামী মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর থেকে দেশটি নতুন করে শাটডাউনে (Government Shutdown) ঢুকতে পারে। এমন হলে সাত বছরের মধ্যে এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শাটডাউন।
এই পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন কিছু অপরিহার্য সেবা চালু থাকবে, অন্যদিকে বহু খাতে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। ফলে জনজীবন ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে।
শাটডাউন মূলত একটি প্রশাসনিক অচলাবস্থা, যখন বাজেট বিল পাস না হওয়ায় সরকারি সংস্থাগুলো অর্থায়ন পায় না। বর্তমানে এর প্রধান কারণ হলো রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বাজেট অনুমোদন নিয়ে সমঝোতার অভাব।
রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের উভয় কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলেও সিনেটে বাজেট পাস করাতে তাদের প্রয়োজনীয় ৬০ ভোট নেই। এই সুযোগে ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের দাবি সামনে এনেছে। তারা বলছে, রিপাবলিকানদের বাজেট প্রস্তাব স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে।
ডেমোক্র্যাটদের মূল দাবিগুলো হলো:
- স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য বিমার ট্যাক্স ক্রেডিট বৃদ্ধি
- মেডিকেইড খাতে ট্রাম্প প্রশাসনের কাটছাঁট বাতিল
- রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (CDC) ও জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (NIH) বাজেট কাটছাঁট বন্ধ
কোনো সমঝোতা না হলে বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিট (EDT) থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি শাটডাউন কার্যকর হবে। এর আগে সর্বশেষ শাটডাউন হয়েছিল ২০১৮ সালে, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে। তখনো বাজেট নিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল।
বর্তমানে শাটডাউন হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন এখনও ডেমোক্র্যাটদের দাবির প্রতি বড় কোনো ছাড় দেয়নি। হোয়াইট হাউস মনে করছে, জনগণ শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটদের দায়ী করবে। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা এবার আরও সংগঠিত ও দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
পূর্বে শাটডাউনকে রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হলেও ট্রাম্প প্রশাসন এবার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। তারা শাটডাউনকে অপ্রয়োজনীয় (non-essential) কর্মীদের চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে ছাঁটাই করার সুযোগ হিসেবে দেখছে।
গত নয় মাসে সরকার ইতোমধ্যেই ব্যয় কমিয়েছে ও কর্মী সংখ্যা হ্রাস করেছে। শাটডাউন হলে তারা এই প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে নিতে পারবে।
শাটডাউনের সময় সব সরকারি সেবা বন্ধ হবে না। কিছু জরুরি সেবা চালু থাকবে, তবে অনেক খাতে জনভোগান্তি বাড়বে।
- সীমান্ত সুরক্ষা
- হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা
- আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা
- বিমান নিয়ন্ত্রণ
- সোসাল সিকিউরিটি ও মেডিকেয়ারের চেক পাঠানো
- খাবার সহায়তা কর্মসূচি
- সরকারিভাবে অর্থায়ন করা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা
- শিক্ষার্থীদের ঋণ প্রদান কার্যক্রম
- খাদ্য পরিদর্শন
- জাতীয় উদ্যান ও পর্যটনকেন্দ্র
দীর্ঘস্থায়ী হলে এর প্রভাব অর্থনীতির উপরও পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শাটডাউন সাধারণ ঘটনা হলেও এর প্রভাব সবসময়ই গুরুতর। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ৩৬ দিনের শাটডাউনে অর্থনীতিতে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার আর পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।
দীর্ঘ শাটডাউন সরকারি কর্মীদের বেতন বিলম্বিত করে, ব্যবসায়িক খাতে আস্থা নষ্ট করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও নেতিবাচক সংকেত পাঠায়।
যুক্তরাষ্ট্রে গত ৫০ বছরে একাধিকবার শাটডাউন হয়েছে। রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে আটবার শাটডাউন হয়েছিল, যদিও সেগুলো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। ট্রাম্পের সময়ে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী শাটডাউন দেখা গেছে, যা প্রমাণ করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেবল সরকারি কার্যক্রম নয়, অর্থনীতিরও বড় ক্ষতি ডেকে আনে।
- রিপাবলিকানরা: বাজেট খরচ কমাতে চায় এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে আগ্রহী।
- ডেমোক্র্যাটরা: জনগণের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চান, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সুরক্ষা বাড়াতে জোর দিচ্ছেন।
এই দ্বন্দ্বের কারণে কোনো সমঝোতা না হলে শাটডাউন অনিবার্য হয়ে উঠছে।
শাটডাউন হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বিভিন্ন সেবা বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা ঋণ পেতে দেরি করে। খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আর জাতীয় উদ্যান বন্ধ হওয়ায় পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, সরকারি কর্মচারীরা বেতন বিলম্বিত পান বা দীর্ঘ সময় বেতনহীন থাকতে হয়। এতে তাদের আর্থিক অনিশ্চয়তা বাড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বৈশ্বিক বাজার যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভরশীল। শাটডাউন হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ধাক্কা লাগে এবং শেয়ারবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন এখন আর নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে প্রতিবারই এটি সাধারণ মানুষ, অর্থনীতি এবং সরকারের সুনামের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা যদি দ্রুত সমঝোতায় না পৌঁছায়, তবে যুক্তরাষ্ট্র আবারও অচলাবস্থায় পড়বে।
স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্য সহায়তা—এসব মৌলিক খাতে রাজনৈতিক টানাপোড়েন যে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, ইতিহাস তার প্রমাণ বহন করছে। তাই দুই দল যদি সমঝোতায় না পৌঁছায়, তবে ক্ষতির বোঝা বইতে হবে সাধারণ নাগরিকদেরই।