ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ব ক্রীড়াবিদদের সরব আহ্বান
ফিলিস্তিনে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবার দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ক্রীড়াবিদরা। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ও মানবিক অঙ্গনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানানো হলেও এবার সরাসরি ক্রীড়াজগতের তারকারা মুখ খুলেছেন। ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফা (UEFA)-র কাছে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে তারা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে ৫০ জন তারকা ক্রীড়াবিদ। তাদের এই উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ক্রীড়াবিদদের মতে, খেলার মাঠে মানবিকতা ও ন্যায়ের মূল্যবোধ অটুট রাখতে হলে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত কোনো রাষ্ট্রকে জায়গা দেওয়া চলতে পারে না।
চিঠিটি পাঠানো হয়েছে ‘অ্যাথলেটস ফর পিস’ নামের একটি উদ্যোগের ব্যানারে। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো—ধর্ম, বর্ণ ও জাতীয়তার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে কণ্ঠ দেওয়া। ক্রীড়াবিদরা মনে করছেন, যদি রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের দায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করা যায়, তবে একই যুক্তিতে ইসরায়েলকেও নিষিদ্ধ করা উচিত।
চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে—
“আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের এমন সুস্পষ্ট লঙ্ঘন যদি অব্যাহত থাকে, তবে নীরব থাকার কোনো সুযোগ নেই। খেলার মাঠ মানবিক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর জায়গা। তাই ইসরায়েলকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা হোক।”
এই চিঠিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন—
- ফরাসি বিশ্বকাপজয়ী তারকা পল পগবা
- ইংল্যান্ডের তারকা ক্রিকেটার মঈন আলী
- চেলসির সাবেক তারকা হাকিম জিয়েচ
- ডাচ উইঙ্গার আনোয়ার এল ঘাজি
- লেস্টার সিটির সাবেক কোচ নাইজেল পিয়ার্সন
এদের প্রত্যেকেই অতীতে মানবিক ইস্যুতে সরব থেকেছেন। এবার ফিলিস্তিনের গণহত্যা ও ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে একসাথে দাঁড়িয়ে তারা বিশ্ব ক্রীড়াজগতে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন আনোয়ার এল ঘাজি। গত বছর তিনি ফিলিস্তিনের পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় অবস্থান নেওয়ার কারণে জার্মান ক্লাব মেইঞ্জ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। ক্লাব ছাড়লেও তিনি নীরব থাকেননি; বরং আরও দৃঢ় কণ্ঠে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
অনেকে মনে করছেন, এল ঘাজির অবস্থান বর্তমান প্রজন্মের ক্রীড়াবিদদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, পেশাদার ক্যারিয়ারের ঝুঁকি নিয়েও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব।
চিঠিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ফিলিস্তিনের কিংবদন্তি ফুটবলার সুলেইমান আল-ওবেইদ-এর মৃত্যুর ঘটনা। যিনি ‘ফিলিস্তিনি পেলে’ নামে পরিচিত ছিলেন। গত আগস্টে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারান এই তারকা।
তার মৃত্যু ক্রীড়াবিশ্বে গভীর শোক ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। চিঠিতে বলা হয়েছে—
“সুলেইমানের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, নীরবতা আর বিকল্প নয়। একজন ক্রীড়াবিদ যখন বোমার নিচে নিহত হন, তখন আমাদের দায়িত্ব হয়ে যায় অবস্থান নেওয়া।”
চিঠিতে ক্রীড়াবিদরা একটি স্পষ্ট যুক্তি দিয়েছেন—রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন পশ্চিমা বিশ্বের যুক্তি ছিল, আগ্রাসন চালানো কোনো রাষ্ট্রকে খেলাধুলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না।
প্রশ্ন উঠেছে—তাহলে ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ভিন্ন মানদণ্ড কেন? ইসরায়েলও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে, নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
উয়েফা এখনও ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তবে ক্রীড়াবিদদের এই উদ্যোগের পর সংস্থাটির ওপর চাপ বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই চিঠি ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে এবং হাজার হাজার সমর্থক এতে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্ট করে জানিয়েছে—২০২৬ বিশ্বকাপে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার যেকোনো প্রচেষ্টা তারা প্রতিহত করবে।
এমন অবস্থান আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সমালোচকরা বলছেন, রাজনীতির প্রভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রে ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ক্রীড়াবিদরা শুধু খেলার মাঠের নায়ক নন; তারা সমাজের আদর্শও বটে। তাই যুদ্ধ, গণহত্যা ও দমননীতির বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠস্বর মানবিক দায়বদ্ধতার অংশ।
ইতিহাসে দেখা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও ক্রীড়াবিদরা অবস্থান নিয়েছিলেন। এবার সেই ঐতিহ্য ফিলিস্তিনের পক্ষে নতুনভাবে ধরা দিল।
এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও প্যালেস্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) ফিফার কাছে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল। তবে এখনও পর্যন্ত ফিফা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে উয়েফার কাছে ক্রীড়াবিদদের চিঠি নতুন করে আলোচনায় এনেছে বিষয়টি। অনেকেই মনে করছেন, যদি উয়েফা কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ফিফাও চাপের মুখে পড়বে।
চিঠির মাধ্যমে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো—এখন আর নীরব থাকা যাবে না। গাজার শিশু, নারী ও ক্রীড়াবিদরা যখন প্রতিদিন বোমার নিচে প্রাণ হারাচ্ছেন, তখন খেলার মাঠে মানবিকতার পতাকা উড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
ফিলিস্তিনে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। তবে এবার সেই নাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শীর্ষ ক্রীড়াবিদদের এই উদ্যোগ প্রমাণ করেছে, খেলার মাঠ কেবল বিনোদনের জায়গা নয়, বরং ন্যায় ও মানবিকতার পক্ষে দাঁড়ানোরও প্ল্যাটফর্ম।
বিশ্বজুড়ে যখন মানুষ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তখন ক্রীড়াবিদদের কণ্ঠস্বর এই আন্দোলনকে আরও শক্তি দিল। এখন দেখার বিষয়, উয়েফা ও ফিফা কতটা দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়।