“তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতি” ও বন্দি-বিনিময়সহ ২০-পয়েন্ট পরিকল্পনায় সম্মতি — বাস্তবায়ন নির্ভর করবে হামাসের প্রতিক্রিয়ার ওপর
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গতকাল (২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন সফরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে মূলভাবেই এক ধরনের মার্কিন-প্রস্তাবিত শান্তি ও যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনায় সম্মতি জানিয়েছেন — যা গাজার দুই বছর ধরে চলমান ভয়ংকর সঙ্কটকে শূন্যে ফিরিয়ে আনতে পারে বলে বিশ্বমিডিয়ায় জানানো হয়েছে। পরিকল্পনাটি পোশাকিভাবে তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, বন্দি-ইনসান বিনিময়, পর্যায়ক্রমিক প্রত্যাহার এবং হামাসের সশস্ত্রীকরণ পর্যায়ে নিরস্ত্রীকরণসহ একাধিক ধাপের বিধান রেখে নির্মিত; তবে চূড়ান্ত কার্যকারিতা নির্ভর করছে হামাসের প্রতিক্রিয়া ও আঞ্চলিক কূটনীতিকদের স্বচ্ছ সহযোগিতার ওপর।
এই প্রতিবেদনে আমরা বিষয়টির পটভূমি, পরিকল্পনার প্রধান ধারগুলো, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব, মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত প্রতিবন্ধকতা, অঞ্চলভিত্তিক প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করেছি — যাতে পাঠকরা সহজভাবে বুঝতে পারেন কেন ইসরায়েলের এই “সম্মতি” আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রস্তুত একটি প্রস্তাবনা (প্রকাশিত ২০-পয়েন্ট বা ২১-পয়েন্টের কাঠামো হিসেবে বর্ণিত) দ্রুত তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতির কথা বলে; এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সকল বন্দির মুক্তি — বিশেষ করে গাজায় বন্দি থাকা ইজরায়েলি নাগরিকদের বিড়ম্বনা সমাধানের তৎপরতা, বন্দি-বন্দীপক্ষের বিনিময়, হামাসের অস্ত্রশক্তি সীমাবদ্ধকরণ ও ভবিষ্যতে একটি অস্থায়ী নাগরিক প্রশাসন গঠনের দায়বদ্ধতা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এই পরিকল্পনায় দলীয় বা ভেতরের রাজনীতির কিছু শর্তসহ সম্মতি জানিয়েছেন, এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে ‘শান্তির পথে বড় ধাপ’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু হোয়াট-হচ্ছে-পরবর্তী তা নির্ভর করছে—হামাস যদি প্রস্তাবে রাজি না হয় বা রয়ে যাওয়া নিরাপত্তাগত শর্তগুলো একে অপরের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করে, তাহলে চুক্তির সফল বাস্তবায়ন অনিশ্চিত।
গাজার ওপর ইসরায়েলের সামরিক অভিযান প্রায় দুই বছর ধরে চলার ফলে জনপদ ধ্বংস এবং ব্যাপক মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপ, অঞ্চলীয় সুপরিকল্পিত কূটনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপ—তিনটি কারণ একসঙ্গে কাজ করায় ইসরায়েলই এক পর্যায়ে যোগসই কূটনৈতিক পথের সন্ধান করতে বাধ্য হয়েছে বলে কূটনৈতিক মহলে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কাতার, মিশর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বেশ কয়েক দফা আলোচনার ফলে যুদ্ধবিরতি বা বন্দি-পরিবর্তন সম্পর্কিত নানা প্রস্তাবনা উঠেছিল; এসবের পেছনে মূল প্রেরক হিসেবে ছিল মানবিক চাপ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পর্য় কূটনৈতিক মধ্যস্থতা এবং পশ্চিমা মিত্রদের উদ্বেগ। পূর্ববর্তীকালের যুদ্ধবিরতির রেকর্ড ও ভাঙনের ইতিহাসও আজকের এই সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করে — কারণ অতীতের চুক্তি ভাঙার ঘটনার স্মৃতি সব পক্ষকেই সতর্ক করে রাখে।
প্রস্তাবনার মূল উপাদানগুলো সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী নিম্নরূপ সংক্ষেপ করা যায় — এভাবেই চূড়ান্ত নথিতে ধারা-ধারা সাজানো হয়েছে বলে বর্ণিত হয়েছে:
- তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতি: উভয়পক্ষ যদি সম্মত হয় তবে হামলা ও প্রতিহিংসামূলক অপারেশন বাতিল করা হবে। এই তাত্ক্ষণিকতা পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হয়েছে।
- বন্দি ও ধরা পড়া ব্যক্তিদের দ্রুত মুক্তি: প্রথম ধাপে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বেশ কিছু বন্দি মুক্তির শর্ত রাখা হয়েছে — রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘৭২ ঘণ্টার মধ্যে’ কিছু বন্দি মুক্তির প্রস্তাব আছে।
- চর বেশি সময়ের পরিকল্পনা: যুদ্ধবিরতি ও বন্দি-পরিবর্তন কার্যক্রমের পরে একটি পর্যায়ক্রমিক প্রত্যাহার ও পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া — যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও অস্থায়ী শাসন ব্যবস্থাও নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
- হামাসের অস্ত্রশক্তি হ্রাস: অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ ও সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সক্ষমতা হ্রাসের একটি মেকানিজম। এটি প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে স্থান পেয়েছে।
- আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান: অস্থায়ী প্রশাসন ও পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক তত্বাবধানের কথা বলা হয়েছে; এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের অংশগ্রহণ বা সহায়তা থাকতে পারে।
এই ধারা গুলোই মূলত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ঘোষণার কেন্দ্রবিন্দু; কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে — এগুলো কেবল তখনই কার্যকরবয়ে পরিণত হবে যখন গাজা-পক্ষ (বিশেষত হামাস) সেগুলো মেনে নেবে এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তৃপ্তিদায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে, কূটনৈতিকভাবে কিছু শর্ত তুলে ধরেন; তবু তিনি মূল প্রস্তাবিত কাগজে সম্মতি জানিয়েছেন — অন্তত মার্কিন ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাতেই এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল কিছুকালীন নিরাপত্তা উপস্থিতি বজায় রাখার ইচ্ছা এবং হামাসকে দুর্বল করার শর্তাবলী মেনে নেওয়া। তিনি কাতারের প্রতি একটি বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন—সংবাদে বলা হয় কাতারের এক কর্মকর্তা মারা যাওয়ার ঘটনার পর ইসরায়েলি পক্ষের অনুশোচনা ও ক্ষমাপ্রার্থনা হয়েছিল। এসব প্রসঙ্গ বৈঠকে উঠে আসে এবং ট্রাম্প এটি “শান্তি প্রক্রিয়ার বড় মোড়” বলে ঘোষণা করেন।
প্রতিবেদন প্রকাশের সময়কালে হামাসের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া যায়নি; মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিশরীয় দফতরগুলো হামাসের প্রতিক্রিয়া নেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকে বলছেন—হামাস যদি বন্দি মুক্তির প্রকৃত তালিকা বা নিরাপত্তা গ্যারান্টির বিষয়ে নিশ্চিত না হয়, তাহলে তারা সহজে প্রস্তাবে সম্মতি দেবে না। অতএব, হাতে থাকা মূল অনিশ্চিয়তাই হলো—“হামাস রাজি হবে কি না”।
গাজার অবকাঠামো ধ্বংসপ্রায়, স্বাস্থ্যসেবা স্তর লঙ্ঘিত এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তবায়ন বিঘ্নিত। ততদিন পর্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ যুদ্ধবিরতি না হলে তাত্ক্ষণিকভাবে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন থাকবে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে তৎক্ষণাত ঘাটতি মেটাতে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে — কিন্তু পুনর্গঠন ও জরুরি পুনর্বাসন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হবে। আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো বহুবার হুমকি দিয়েছে যে, যদি ততক্ষণ সহায়তা অব্যাহত নাও থাকে, গাজার জনসংখ্যার ওপর ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় কড়া রূপ নেবে।
এ ধরনের একটি সমঝোতা যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান বদলে দিতে পারে — সৌদি আরব, ইজিপ্ট, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো কীভাবে সাড়া দেয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই সমর্থন প্রকাশ করেছে, আবার কিছু দেশ সতর্ক মনোভাবেই অবস্থান রেখেছে। বিশেষত কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ও ডোহা-ঘটনার পর ইজেন্ডা পুনরায় স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ইস্যু। মুখ্যত: ইসরায়েল যদি আঞ্চলিক সমর্থন না পান, তাহলে বাস্তবায়ন সহজ হবে না।
বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন ইজরায়েলি নাগরিক, সৈন্য এবং গাজায় থাকা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বিনিময় পরীক্ষায় সাধারণতঃ কশাখা পর্যায়ের বন্দি-প্রবণতা (সেকেন্ডারি বন্দি ও রাজনৈতিক গ্রেপ্তারকৃত বেসামরিক ব্যক্তিও থাকতে পারে) বিবেচ্য হয়। প্রস্তাবনায় যে ধারাগুলি দেখা গেছে — তা আনুষঙ্গিকভাবে পর্যায়ভিত্তিক বন্দি মুক্তির কথা বলে, কিন্তু তালিকা ও নিরাপত্তা প্রটোকল নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকায় হামাস বা অন্য কোনো পক্ষ তা তাত্ক্ষণিকভাবে মেনে নাও নিতে পারে। বন্দি-পরিবর্তনের স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করা হলে তা আঞ্চলিক আস্থা বাড়াবে; অন্যথায় পারস্পরিক সন্দেহই বাস্তবায়ন বিঘ্নিত করবে।
এই ধরনের চুক্তি বাস্তবায়নে বেশ কিছু স্পষ্ট ঝুঁকি রয়েছে:
- হামাসের গ্রহণযোগ্যতা — হামাস যদি প্রস্তাবে রাজি না হয় বা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব ভিন্ন অবস্থান নেয়, তাহলে চুক্তি কার্যত অপ্রয়োগ্য।
- অভ্যন্তরীণ ইসরায়েলি রাজনীতি — নেতানিয়াহুর ভেতরের দলীয় বাধা ও প্রজন্মগত নিরাপত্তা-চিন্তা চূড়ান্ত রাজী হলে কার্যকর বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হবে না।
- নিরাপত্তা গ্যারান্টি — অস্ত্র হ্রাস ও নিরস্ত্রীকরণ কিভাবে পরখ করা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলে পুনরুদ্ধারের ঝুঁকি থাকে।
- আঞ্চলিক দমবন্ধন — কাতার, মিশর ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী সাথে না থাকলে বা তাদের সমর্থন দুর্বল হলে চুক্তি ঝরঝরে হবে না।
- মানবিক সাহায্যের তত্ত্বাবধান — তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতির মধ্যে মানবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাদের নিরাপত্তা ও লজিস্টিক প্রটোকল দরকার।
যুদ্ধবিরতি ও বন্দি-আদানপ্রদানের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আওতায় পড়ে। যে কোনো সমঝোতা নাগরিকদের সুরক্ষা, স্থায়ী মানবিক সহায়তার নিশ্চয়তা ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নিশ্চিত করবে কি না— সেটাই নির্ধারণ করবে চুক্তির নৈতিক বৈধতা। কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করে বলছেন— কেবল মিলিটারি স্তরে শান্তি নয়, যদি দীর্ঘমেয়াদি নাগরিক প্রশাসন ও অধিকার-প্রতিষ্ঠা না হয়, তাহলে পুনরায় সংঘাতের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
- সংক্ষিপ্তকালীন: যদি হামাস দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায় এবং নিশ্ছিদ্রভাবে বন্দি-লিস্ট ও মুক্তি-প্রক্রিয়া বাস্তবে আসে, তাহলে তাত্ক্ষণিক যুদ্ধবিরতি শুরু হতে পারে; নানান মানবিক সংকট কিছুটা শিথিল হবে।
- মধ্যকালীন: আন্তর্জাতিক তত্বাবধান ও পুনর্নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হলে গাজার অবস্থা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হওয়া সম্ভব। তবে সেজন্য অর্থনৈতিক সহায়তা, বেসরকারি পুনর্গঠন ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান জরুরি।
- দীর্ঘমেয়াদি: যদি অস্ত্রশক্তি হ্রাস এবং রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়, তাহলে অঞ্চলীয় স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেতে পারে; অন্যথায় পুনরায় সংঘাতের সম্ভাবনা রয়ে যাবে।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্বের এখন যে মৌখিক বা আনুষ্ঠানিক সম্মতি এসেছে, তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ—কারণ এটি কূটনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙার সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। তবুও, বাস্তবে ‘গাজা যুদ্ধ বন্ধ’ ঘোষণা করার আগে তিনটি শর্ত প্রয়োজন: (১) হামাসের স্পষ্ট ও অনবদ্য সম্মতি, (২) বন্দি-পরিবর্তন ও তাত্ক্ষণিক মানবিক সহায়তা কার্যকরভাবে শুরু হওয়া, এবং (৩) আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের স্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এই তিনটি শর্ত পূর্ণ হলে কেবলই বলা যাবে যে যুদ্ধ বন্ধে বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে; নতুবা এটি কেবল কূটনৈতিক আশ্বাসের স্তরে থেকেই যেতে পারে।