দেশ ছাড়বেন না, সাংবিধানিক ধারায় ফেরার অঙ্গীকার করলেন কেপি শর্মা অলি
নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গনে একের পর এক নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি। জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর থেকেই তিনি ছিলেন কার্যত লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে অবশেষে জনসম্মুখে এসে স্পষ্ট জানালেন—তিনি দেশ ছেড়ে যাবেন না, পালাবেন না, বরং নেপালকে আবারও সাংবিধানিক মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে লড়াই চালিয়ে যাবেন।
সম্প্রতি ভক্তপুরে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (ইউএমএল) যুব সংগঠনের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অলি সরাসরি সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার জনগণের ম্যান্ডেটে নয়, বরং ভাঙচুর, আগুন-সন্ত্রাস এবং অগণতান্ত্রিক চক্রান্তের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে।
এই প্রতিবেদনে নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকট, কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ-পরবর্তী অবস্থান, বিক্ষোভের প্রেক্ষাপট এবং তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।
নেপালের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জি নেতৃত্বাধীন তরুণ সমাজ, দীর্ঘদিন ধরে দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছিল। দুর্নীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা তাদের ক্ষোভের মূল কারণ।
গত আগস্ট থেকে নেপালের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থী ও তরুণদের উদ্যোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। দ্রুতই সেটি রূপ নেয় সর্বজনীন প্রতিবাদে। আন্দোলনকারীরা দাবি তুলেন—দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিচার এবং জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট প্রতিফলিত হয় এমন সরকার গঠন করতে হবে।
এই তরঙ্গ যখন রাজধানী কাঠমান্ডুতে পৌঁছায়, তখন পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারি ভবন ও রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভকারীদের স্লোগান, মিছিল এবং মাঝে মাঝে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
কেপি শর্মা অলি নেপালের রাজনীতিতে বিতর্কিত হলেও অত্যন্ত প্রভাবশালী এক নাম। একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই কমিউনিস্ট নেতা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মূলত বিক্ষোভের প্রবল চাপে।
৯ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডুতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন বিক্ষোভকারীরা সরাসরি ভক্তপুরে অলির ব্যক্তিগত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেনাবাহিনী দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করলেও ওই ঘটনার পর থেকে তিনি পুরোপুরি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে চলে যান।
অলি সরকারি বাসভবন ছেড়ে দেন এবং সেনা সুরক্ষায় অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। পরে জানা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর ভক্তপুরের গুন্ডু এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় তিনি অবস্থান নিচ্ছেন।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সরাসরি জনসম্মুখে না আসা অলি গত শনিবার অবশেষে এক অনুষ্ঠানে হাজির হন। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি ভক্তপুরে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (ইউএমএল) যুব সংগঠনের সভায় অংশ নেন।
সেখানে বক্তৃতায় অলি সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেন—
“আপনারা কি মনে করেন আমরা এই ভিত্তিহীন সরকারের হাতে দেশ তুলে দিয়ে পালিয়ে যাব?”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তিনি দেশ ছাড়বেন না। বরং তিনি দেশকে আবারও সাংবিধানিক ধারায় ফিরিয়ে আনার লড়াই চালিয়ে যাবেন।
অলি বর্তমান সরকারের প্রতি বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তিনি দাবি করেন, এই সরকার জনগণের ভোটে নয়, বরং সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গঠিত।
এছাড়া তিনি অভিযোগ করেন, সরকার তাঁর পাসপোর্ট স্থগিত করার চেষ্টা করছে, মামলা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এবং তাঁকে দেশ থেকে তাড়ানোর ষড়যন্ত্র করছে।
তাঁর ভাষায়:
“সামাজিক মাধ্যমে আমার নতুন বাসার অবস্থান খুঁজে বের করে হামলার কথা বলা হচ্ছে। সরকার কী করছে? শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে?”
অলি আরও বলেন, যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বিক্ষোভ দমনে কী ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা সরকারের উচিত প্রকাশ করা। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকির উদ্দেশে বলেন, “সাহস থাকলে আমার নির্দেশনার রেকর্ড প্রকাশ করুন।”
এর মাধ্যমে অলি বোঝাতে চান, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, অথচ বর্তমান সরকার তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
৯ সেপ্টেম্বর ভক্তপুরে অলির ব্যক্তিগত বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি শুধু নেপাল নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ, দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে এমন সরাসরি হামলা নেপালের রাজনৈতিক সংকটকে আরও প্রকটভাবে প্রকাশ করে।
এই ঘটনার পর থেকে অলি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার তাঁকে যথাযথ নিরাপত্তা দিচ্ছে না। বরং তাঁকে আরও কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে।
অলি পরিষ্কার করেছেন যে তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন না। বরং নতুন করে রাজনৈতিক মঞ্চে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, “আমরা দেশকে শান্তি ও সুশাসনের পথে ফেরাব।”
অলি আরও দাবি করেন, জনগণ এখনো তাঁর পাশে আছে এবং তিনি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য মাঠে থাকবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি। একদিকে জেন-জি তরুণদের নেতৃত্বে চলমান বিক্ষোভ, অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সংকট—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়েছে।
অলির জনসম্মুখে প্রত্যাবর্তনকে অনেকে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর সমর্থক ঘাঁটিকে নতুন করে সক্রিয় করতে চাইছেন।
নেপালের রাজনৈতিক সংকট আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র নেপালের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছে।
অলির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মামলা বা পাসপোর্ট স্থগিতের মতো পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও আলোচনার জন্ম দেবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল।
কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ-পরবর্তী সময়ে নেপাল অভূতপূর্ব রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে চলমান বিক্ষোভ একদিকে সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তন নেপালের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণকে নতুন রূপ দিচ্ছে।
অলি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পালাবেন না, দেশ ছেড়ে যাবেন না। বরং সাংবিধানিক ধারায় ফেরার লড়াই তিনি চালিয়ে যাবেন। এখন দেখার বিষয়—এই প্রত্যাবর্তন নেপালের রাজনীতিকে নতুন দিকনির্দেশনা দেয় নাকি আরও অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেয়।