তৌকির রাজা আটক, শতাধিক গ্রেপ্তার ও দাঙ্গা মামলায় ১৭০০ জন অজ্ঞাত আসামি
ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বেরেলি জেলাকে ঘিরে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ প্রচারণাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি এতটাই বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে যে, রাজ্যের একাধিক জেলায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও দাঙ্গার পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় আলেম ও ইত্তেহাদে মিল্লাত কাউন্সিলের প্রধান তৌকির রাজাকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়।
‘আই লাভ মুহাম্মদ’ প্রচারণা শুরু হয়েছিল চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবীর মিছিল থেকে। কানপুরের একটি মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা একটি তাবুতে “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা পোস্টার টানায় হিন্দু সংগঠনগুলোর আপত্তি ওঠে। তাঁদের অভিযোগ— সেই স্থানেই প্রতিবছর রামনবমীর মতো হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, ফলে এটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক উসকানি। এরপর থেকেই হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #ILoveMuhammad হ্যাশট্যাগ দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়লে বিষয়টি দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রে আসে। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বারাণসীতে হিন্দু ধর্মীয় নেতারা ‘আই লাভ মহাদেব’ লেখা পোস্টার নিয়ে মিছিল করেন।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেরেলিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিপুলসংখ্যক মানুষ তৌকির রাজার বাসার সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন এবং হাতে পোস্টার বহন করেন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে।
পুলিশের অভিযোগ অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীরা পাথর নিক্ষেপ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিচার্জ করে। সংঘর্ষে বহু মুসলিম আহত হন, পাশাপাশি অন্তত ১০ জন পুলিশ সদস্যও জখম হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক ঘণ্টা ধরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে এলাকায়।
এ ঘটনায় অন্তত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া আরও প্রায় ৫০ জনকে হেফাজতে নেওয়া হয়। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, দাঙ্গা ও হামলার অভিযোগে প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শুধু বেরেলিই নয়, উত্তর প্রদেশের মৌ জেলাতেও শুক্রবার একই ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে নামাজ শেষে বিক্ষোভকারীদের ভিড় পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে চাইলে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। একইভাবে উনাও, মহারাজগঞ্জ, লক্ষ্ণৌ ও কোসাম্বিতেও উত্তেজনার খবর পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে গুজরাটের গান্ধীনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোক দোকানপাট ও গাড়ি ভাঙচুর করে, কর্ণাটকের দাভাঙ্গেরেতেও পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ফলে “আই লাভ মুহাম্মদ” প্রচারণা কেন্দ্রীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
হিন্দু সংগঠনগুলোর দাবি, তাঁদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের স্থানকে লক্ষ্য করে উসকানিমূলকভাবে এই পোস্টার টানানো হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মতে, এটি তাঁদের ধর্মীয় ভালোবাসার প্রকাশ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
তৌকির রাজা এ বিষয়ে দেওয়া ভিডিওবার্তায় বলেন, নবীজি (সা.)-র প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ কোনো অপরাধ নয়। তবে সেই বক্তব্যের পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তিনি পুলিশের হেফাজতে যান।
উত্তর প্রদেশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের যেকোনো চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে বাড়তি সতর্কতা ও কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় বিষয়টি এখন জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ছোট্ট একটি প্রচারণা স্লোগান থেকে শুরু হওয়া এ ঘটনা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করতে পারে।
‘আই লাভ মুহাম্মদ’ প্রচারণাকে ঘিরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে তা দেশটির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে মুসলিমরা নবীজি (সা.)-র প্রতি ভালোবাসার প্রকাশে অনড়, অন্যদিকে হিন্দু সংগঠনগুলো এটিকে তাঁদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে উদ্দেশ্যমূলক আঘাত হিসেবে দেখছে। প্রশাসন পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করলেও এ ঘটনা যে আরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, তার আশঙ্কা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।