বাংলাদেশের ব্যয় বেড়েছে ২৬৩ শতাংশ, স্থানীয় এনজিওর প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার দাবি
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা সংকট নতুন মাত্রা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতাদের অনুদান ক্রমশ কমে আসছে, অথচ বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে কয়েক গুণ। সর্বশেষ কোস্ট ফাউন্ডেশন ও কক্সবাজার সিএসও-এনজিও ফোরামের (সিসিএনএফ) এক গবেষণায় উঠে এসেছে—যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অনুদান কমানোর কারণে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা আংশিক পূরণ করতে বিশ্বব্যাংক নতুন করে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে।
এই প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার, তবে তা দেওয়া হয়েছে ঋণ আকারে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকেই বাড়তি ঋণের বোঝা বইতে হবে। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিল, ২০২৫ সালে এসে সেই অনুদান কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৫ মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক বছরে ৭২ শতাংশ অনুদান কমানো হয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাজ্যের অনুদান ৪৮ শতাংশ কমেছে—২০২৪ সালে ৪৬ মিলিয়ন ডলার থাকলেও এ বছর তা নেমে এসেছে মাত্র ২৪ মিলিয়ন ডলারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরণের অনুদান হ্রাস বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচরে অবস্থান করছে, যাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। অনুদান কমলে স্বাভাবিকভাবেই এসব খাতে সঙ্কট তৈরি হবে।
আন্তর্জাতিক অনুদান কমে আসায় ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। ২০২৪ সালে যেখানে সরকার রোহিঙ্গা খাতে মাত্র ১১ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল, ২০২৫ সালে তা বেড়ে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের ব্যয় বেড়েছে ২৬৩ শতাংশ।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক শাহিনুর ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে মোট ৬৩টি প্রকল্প অনুমোদিত ও শুরু হয়েছে। কিন্তু এর বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বড় এনজিওগুলো পরিচালনা করছে। স্থানীয় এনজিওগুলো ন্যূনতম তহবিল পাচ্ছে।”
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “কক্সবাজার শহর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়া-আসা করতে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় লাগে। শহরে বসে বড় বড় আইএনজিও প্রকল্প পরিচালনা করে, যার ফলে খরচও বেড়ে যায়। অথচ স্থানীয় এনজিওগুলো অনেক কম খরচে একই ধরণের প্রকল্প পরিচালনা করতে সক্ষম।”
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোহিঙ্গা খাতে বর্তমানে স্থানীয় এনজিওগুলো মাত্র ৪.৮ শতাংশ তহবিল পায়। অথচ তাদের দক্ষতা ও মাঠপর্যায়ে উপস্থিতি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চেয়ে বেশি কার্যকর। তাই স্থানীয় এনজিওর প্রতি গুরুত্ব বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবিলায় শুধু খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে রাখা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কোস্ট ফাউন্ডেশনের যুগ্ম নির্বাহী পরিচালক ইকবাল উদ্দিন বলেন, “রোহিঙ্গাদের শুধু মুখে তুলে খাওয়ানোর জন্য রাখা উচিত নয়। বরং তাদেরকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। তারা যেন কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় এবং সমাজে অবদান রাখতে পারে, সে ব্যবস্থা করা দরকার।”
তবে এই মতের বিপরীতে অনেকেই নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়লে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, “উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এর বিপরীতে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।”
তার মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যথায় কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে সামাজিক দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যেতে পারে।
‘রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তার স্থানীয়করণ’ শিরোনামের গবেষণার জন্য চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাম্পে সরেজমিন জরিপ চালানো হয়। এছাড়া ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন, নথি ও প্রকাশিত তথ্যের ওপর নির্ভর করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিবেদনটি তুলে ধরে যে, ২০১৭ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ ক্রমশ কমছে। প্রথমদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সহায়তা আসলেও এখন তা তীব্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্বব্যাপী চলমান একাধিক যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দাতারা নতুন করে রোহিঙ্গা সংকটে অর্থ বরাদ্দ কমাচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার মানবিক বিপর্যয়, আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ—এসব কারণে অনুদানদাতাদের মনোযোগ অন্যত্র সরে গেছে।
ফলে বাংলাদেশের কাঁধে চাপছে অতিরিক্ত বোঝা। বিশ্বব্যাংকের ঋণ-সহায়তা সাময়িকভাবে স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি নতুন আর্থিক সংকট তৈরি করতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে—
- স্থানীয় এনজিওগুলোর জন্য ন্যূনতম ২৫ শতাংশ তহবিল বরাদ্দ রাখা।
- রোহিঙ্গাদের মানবসম্পদে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া।
- আন্তর্জাতিক দাতাদের আবারও অনুদান বাড়ানোর জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা।
- প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় গতি আনা।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকটে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু দাতাদের অনুদান কমতে থাকলে একা বাংলাদেশের পক্ষে এই সংকট সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প সাময়িক সমাধান দিলেও তা ঋণের বোঝা বাড়াবে। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।
রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত। তাই টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।