বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ বাজেয়াপ্ত
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরি মামলার অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। ফিলিপাইনের মাকাতি সিটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) ব্যাংকে থাকা মোট ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ আইনি লড়াই, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার ফলেই এই বাজেয়াপ্তি সম্ভব হয়েছে।
আজ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন খান গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বাজেয়াপ্ত অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অ্যাকাউন্টে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাইবার হামলা হয়। দুর্বৃত্তরা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে সুইফট কোড হ্যাকিং এর মাধ্যমে একযোগে প্রায় ৯৫ কোটি ডলার স্থানান্তরের চেষ্টা করে। তবে বিভিন্ন দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্দেহ তৈরি হওয়ায় বড় অংশ আটকে যায়।
এরপরও প্রায় ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হয়। ওই অর্থের একটি বড় অংশ স্থানীয় ক্যাসিনো শিল্পে প্রবাহিত হয়, যা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে।
চুরির ঘটনার এক মাস পর, ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের উপ-পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) এর ৪ ধারা, তথ্য ও প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৪ ধারা এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এরপর থেকেই মামলাটি সিআইডির অধীনে তদন্তাধীন রয়েছে। সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, এই চুরির সঙ্গে দেশের ভেতরের কিছু অসাধু চক্রও জড়িত থাকতে পারে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় সাইবার হামলা সফল হওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার এই অর্থ ফেরত আনার জন্য ফিলিপাইনের সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছিল। ফিলিপাইনের আদালতে দীর্ঘদিন ধরে চলা আইনি লড়াই শেষে অবশেষে অর্থ বাজেয়াপ্ত করার রায় পাওয়া যায়।
এই বাজেয়াপ্ত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে ফিলিপাইন সরকারের সদিচ্ছা এবং দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, দেশের ভাবমূর্তির ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের দুর্বলতা নিয়ে নানা সমালোচনা হয়।
তবে বাজেয়াপ্ত অর্থ ফেরত পাওয়া দেশের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই অর্থ ফেরত আসা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং জনগণের আস্থাও কিছুটা পুনরুদ্ধার হবে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, নিয়মিত অডিট, সাইবার বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নয়, মানবসম্পদকেও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। কারণ অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাজে লাগিয়েই হ্যাকাররা সফল হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার অর্থ বাজেয়াপ্ত হওয়া নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি বড় সাফল্য। দীর্ঘ ৮ বছরের প্রচেষ্টার পর এই সাফল্য অর্জিত হলো। এখন সবার প্রত্যাশা, দ্রুত এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।