অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে কঠোর বার্তা, সংস্কার ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন দাবি
রাজধানী ঢাকার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আয়োজিত সমাবেশে পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। দলের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেছেন, “পিআর পদ্ধতি নিয়ে কোনো সংশয় থাকলে গণভোট দেন। জনগণ চাইলে হবে, না চাইলে হবে না।”
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বাদ জোহর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার উদ্যোগে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ব সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হলে ফ্যাসিস্ট শাসক তৈরি হবে না, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে না এবং ভোট ছিনতাই বা কেন্দ্র দখলের পথ রুদ্ধ হবে। তিনি দাবি করেন, পিআরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে এবং সংসদ হবে জনগণের প্রকৃত প্রতিফলন।
তাঁর ভাষায়—
“পিআর নির্বাচনে কোনো দলের পক্ষে সন্ত্রাস করে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। সব মত, পথ ও শ্রেণির মানুষ সংসদে প্রবেশ করতে পারবে। আর কোনো দাবির জন্য রাজপথে নেমে আসতে হবে না।”
সমাবেশে তিনি বিএনপির প্রতিও বার্তা দেন। বলেন, বিএনপির একজন উচ্চপর্যায়ের নেতা দাবি করেছেন তাঁরা নির্বাচনে ৯০ শতাংশ ভোট পাবেন। তাহলে বিএনপির পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করার কোনো কারণ নেই।
“তারা তো জাতীয় সরকার এবং সবার সম্পৃক্ততা চান। পিআর তো তাদেরই চাওয়া হওয়া উচিত।”
মুফতি ফয়জুল করীম অভিযোগ করে বলেন, ভারত নাকি জুলাই সনদ চায় না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন—
“আপনারা কি ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন? অন্তর্বর্তী সরকার শুধু নির্বাচন দেয়ার জন্য আসেনি। তাদের দায়িত্ব সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার এবং তারপর নির্বাচন। আর নির্বাচন হতে হবে পিআর পদ্ধতিতে। কারণ দেশের ৮০ শতাংশ জনগণ পিআরের পক্ষে।”
প্রাইমারি স্কুলে গান ও নাচের শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করার দাবিও জানান তিনি। তাঁর মতে, মুসলমানদের ট্যাক্সের টাকায় নাচ-গানের শিক্ষক নিয়োগ ইসলামসম্মত নয়।
“যদি শিক্ষক নিয়োগ দিতেই হয় তবে কম্পিউটারের শিক্ষক দিন। ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
সমাবেশে দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইমতিয়াজ আলমের সভাপতিত্বে সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আব্দুল কাউয়ুম, মুফতি রেজাউল করীম আবরার, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, কেএম শরীয়াতুল্লাহ, মাওলানা আরিফুল ইসলাম, মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাকি ও মাওলানা খলিলুর রহমানসহ শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেন।
তাঁরা একযোগে বলেন—
- সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে না।
- নির্বাচন হতে হবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিতে।
- পিআর পদ্ধতির বাইরে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
- যারা নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে তাদের জনগণ বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।
সমাবেশ শেষে বিকাল ৩টায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড় হয়ে আবার জাতীয় মসজিদের সামনেই শেষ হয়। এতে হাজার হাজার নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ ছিল।
মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয়—
- “যদি না হয় পিআর, আবার ফিরবে স্বৈরাচার”
- “জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন চাই”
এতে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
এই সমাবেশ কেবল ইসলামী আন্দোলনের নয়, বরং একাধিক ইসলামী দলের যৌথ কর্মসূচির অংশ। জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সাতটি রাজনৈতিক দল বৃহস্পতিবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছে।
তাঁরা সবাই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানান।
সমাবেশে জানানো হয়—
- শুক্রবার দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল হবে।
- ২৬ সেপ্টেম্বর সব জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
এভাবে ধাপে ধাপে আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসলামী দলগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামী আন্দোলনের এ ধরনের অবস্থান মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ সরকারের হাতে এখন সীমিত সময়, অথচ সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের জন্য জনগণের প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছে।
তাঁদের মতে, পিআর পদ্ধতির দাবি নতুন নয়, তবে এবার তা শক্তিশালী স্লোগান হিসেবে ইসলামী দলগুলো জাতীয়ভাবে উত্থাপন করেছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে, নইলে আন্দোলন আরও বিস্তৃত হবে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি ভোটে বিজয়ী প্রার্থী সংসদে আসীন হন (FPTP)। কিন্তু Proportional Representation (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে সংসদে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে।
এ ব্যবস্থায়—
- কোনো দল ২০% ভোট পেলে সংসদে প্রায় ২০% আসন পাবে।
- একক প্রার্থীর আধিপত্য থাকবে না।
- ছোট ও প্রান্তিক রাজনৈতিক দলগুলোও প্রতিনিধিত্ব পাবে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন—
- এতে কালো টাকার দাপট কমবে।
- ভোট ডাকাতির সুযোগ থাকবে না।
- গণতন্ত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
- সংসদ হবে সত্যিকারের জনগণের প্রতিচ্ছবি।
বায়তুল মোকাররমে ইসলামী আন্দোলনের এই সমাবেশ কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী কাঠামো নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ—
- সংস্কার কার্যক্রম শেষ করা।
- জুলাই গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করা।
- পিআর পদ্ধতি নিয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া।
জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। অন্যথায় “সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়” স্লোগান আগামীতে আরও জোরালো হতে পারে।