দেশের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়েই সীমিত ও উচ্চমূল্যে রপ্তানির সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুপরিচিত। প্রতিবছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের অনুরোধে সীমিত পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি করা হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছেন, ভারতের অনুরোধে এবার দুর্গাপূজায় ১২০০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা কম এবং মূল্যও বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বুড়ির বাঁধ সংলগ্ন জলাশয়ে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এ ঘোষণা দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। জেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরের যৌথ আয়োজনে এ সভায় তিনি বলেন—
- দেশের চাহিদাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অনুরোধে সীমিত আকারে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে।
- এবারে আগের তুলনায় অনেক কম এবং তুলনামূলক উচ্চমূল্যে ইলিশ রপ্তানি হবে।
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “অবৈধ রিং জাল তৈরি, বিক্রি বা ব্যবহারকারীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। জলজ সম্পদ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সভায় জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা সভাপতিত্ব করেন। আরও উপস্থিত ছিলেন—
- মৎস্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ
- পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম
- জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন
- স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলে ও ব্যবসায়ীরা
সভায় বক্তারা ইলিশের প্রজনন, অবৈধ জাল ব্যবহার রোধ এবং দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে মতামত প্রদান করেন।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিবছর দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বাংলাদেশের ইলিশের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী সম্পর্কের অংশ হিসেবে সীমিত পরিমাণে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়ে আসছে।
তবে—
- গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরে ইলিশের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
- বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার রপ্তানি সীমিত করছে।
- জেলেদের স্বার্থ রক্ষা ও প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
২০২৫ সালের দুর্গাপূজায় ইলিশ রপ্তানি নিয়ে কয়েকটি বিশেষ বিষয় আলোচনায় এসেছে—
- কম পরিমাণ রপ্তানি: গত বছর যেখানে প্রায় ২,৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছিল, এবার সেই পরিমাণ কমিয়ে ১,২০০ মেট্রিক টন করা হয়েছে।
- উচ্চমূল্য নির্ধারণ: দেশীয় বাজারের চাপ সামলাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি ধরা হয়েছে।
- দেশের চাহিদা অগ্রাধিকার: সরকার বারবার বলছে, দেশের ভোক্তাদের স্বার্থই আগে দেখা হবে।
বাংলাদেশের বাজারে ইলিশের দাম বরাবরই আলোচনার বিষয়।
- মৌসুমে ইলিশের জোগান বাড়লেও দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
- মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর নদীতে ইলিশের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
- তবুও পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম উঁচু অবস্থানে রয়েছে।
এ কারণে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রপ্তানির ফলে বাজারে দাম আরও বাড়তে পারে। তবে সরকার বলছে, রপ্তানির সংখ্যা সীমিত থাকায় এর প্রভাব খুব বেশি পড়বে না।
জেলেরা সাধারণত রপ্তানিকে ইতিবাচকভাবে দেখেন। কারণ—
- রপ্তানির কারণে তারা ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন।
- বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে রাষ্ট্রের আয় বাড়ে।
- তবে সরকারের অভিযান ও অবৈধ জাল বিরোধী ব্যবস্থার কারণে তাদের মধ্যে কিছুটা শঙ্কাও কাজ করে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলেরা সভায় বলেন, “আমরা চাই সরকার আমাদের স্বার্থ রক্ষা করুক। অবৈধ জাল বন্ধ হোক, যাতে আমরা সহজে মাছ ধরতে পারি।”
বাংলাদেশের নদ-নদীতে ইলিশ আহরণে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অবৈধ রিং জাল ও কারেন্ট জাল।
- এ ধরনের জাল মাছের ডিম ও ছোট মাছ ধ্বংস করে দেয়।
- দীর্ঘমেয়াদে ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হয়।
- দেশের মৎস্যসম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে।
ফরিদা আখতার সতর্ক করে দিয়েছেন যে, অবৈধ জাল উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কেবল জেলেদের উপর দায় চাপানো হবে না, বরং পুরো চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—
- রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ: সীমিত পরিমাণ রপ্তানি করা হলে দেশের চাহিদা ও বৈদেশিক চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব।
- মূল্য স্থিতিশীলতা: উচ্চমূল্যে রপ্তানি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
- অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণ: কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হলে নদীতে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে।
তবে তারা সতর্ক করেছেন যে, দেশের বাজারে ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে গেলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইলিশ রপ্তানি একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিষয়।
- প্রতিবছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মানুষেরা দুর্গাপূজায় বাংলাদেশের ইলিশকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
- সীমিত পরিমাণ রপ্তানি দুই দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে।
- এ কারণে সরকার প্রতিবেশী সম্পর্কের দিকটি বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
ইলিশ বাংলাদেশের গর্ব, জাতীয় অর্থনীতির একটি বড় সম্পদ এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুর্গাপূজায় প্রতিবেশী ভারতের জন্য ১২০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি দেশের জন্য যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি করবে, তেমনি দেশের বাজার ও সাধারণ মানুষের জন্যও একটি বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে।
সরকার যদি দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয় এবং অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে যদি বাজারে ইলিশ আরও অস্বাভাবিক দামে পৌঁছে যায়, তাহলে এই রপ্তানি সিদ্ধান্ত সমালোচিত হতে পারে।
অতএব, দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।