জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (জাকসু) শিবিরের প্রভাবশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর ভূমিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচন বরাবরই জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয়জয়কার দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় তুলেছে।
এই নির্বাচনে শিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা শুধু অংশগ্রহণই করেনি, বরং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে জয়লাভ করেছে। ফলে শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে যে একচেটিয়া আধিপত্য চলছিল, সেখানে একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে প্রায় ১১ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থী ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
- মোট ২৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৭৭ জন প্রার্থী।
- সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৯ জন প্রার্থী।
- সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে লড়েছেন ৮ জন প্রার্থী।
- যুগ্ম সম্পাদক (এজিএস) পদে ছিলেন ১৬ জন প্রার্থী।
- নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ জন।
এবারের নির্বাচনে মোট আটটি পূর্ণ ও আংশিক প্যানেল অংশগ্রহণ করে। তবে ভোটগ্রহণ চলাকালে কারচুপির অভিযোগ তুলে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলসহ পাঁচটি জোট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। এ কারণে নির্বাচনের শেষভাগে শিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা তুলনামূলক সহজ অবস্থানে চলে আসেন।
ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা এ নির্বাচনে একাধিক পদে জয়লাভ করে। বিশেষ করে—
- সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে তাদের সমর্থিত প্রার্থী জিতেন।
- বিভিন্ন সাংগঠনিক ও কার্যকরী পদেও তারা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন।
- সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও যুগ্ম সম্পাদক (এজিএস) পদেও তাদের সমর্থিত প্রার্থীরা ভালো ফলাফল অর্জন করেন।
ফলে জাকসুর কার্যক্রম পরিচালনায় শিবির এবার একটি প্রভাবশালী অবস্থান নিশ্চিত করেছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
- শিবিরের বিজয় মূলত দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক পরিশ্রমের ফল।
- ছাত্ররাজনীতিতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রশ্নে শিবিরের অবস্থান শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করেছে।
- তারা মনে করেন, শিক্ষাঙ্গনে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে শিবির কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে।
- নির্বাচনের দিন কয়েকটি প্যানেলের বর্জন শিবিরের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
- যদি সব দল নির্বাচন করত, তবে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্ত চিন্তার অঙ্গনে শিবিরের আধিপত্যকে তারা শঙ্কার চোখে দেখছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরেই প্রগতিশীল রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সেখানকার ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট ও প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ জোট অতীতে প্রভাব বিস্তার করেছে।
কিন্তু এবার শিবিরের সাফল্য কয়েকটি কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ—
- রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি: শিক্ষাঙ্গনে একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে নতুন ভারসাম্য এসেছে।
- জাতীয় রাজনীতিতে বার্তা: জাতীয় রাজনীতির মাঠে শিবির এখনো সক্রিয় এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী—এটি তারা প্রমাণ করেছে।
- তরুণদের সম্পৃক্ততা: বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ভোটারদের একাংশ শিবিরকে সমর্থন করেছেন, যা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি জাতীয় রাজনীতির দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করেছে।
- ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছে।
- ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সফল হয় মূলত ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে।
- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে জাকসু নির্বাচনে শিবিরের জয় কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ চিত্রও নির্দেশ করছে।
নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ চলাকালে কারচুপির অভিযোগ তুলে একাধিক প্যানেল ভোট বর্জন করে। এর মধ্যে ছিল—
- ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল
- প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য
- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
- ছাত্র ফ্রন্টের ‘সংশপ্তক পর্ষদ’
- স্বতন্ত্রদের ‘অঙ্গীকার পরিষদ’
বহু বিশ্লেষকের মতে, এসব জোট যদি শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত, তাহলে শিবিরের জয় অনেক কঠিন হয়ে যেত। তাই তাদের বর্জন শিবিরের জন্য নির্বাচনী সুবিধা তৈরি করেছে বলেই ধারণা।
শিবিরের এই জয় তাদের জন্য যেমন বড় সাফল্য, তেমনি সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
- শিক্ষার্থীদের আস্থা ধরে রাখা: নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থীদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি থাকবে।
- প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করেই শিবিরকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
- বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ক: বর্জনকারীদের সঙ্গে বিরূপ সম্পর্ক মিটিয়ে সহযোগিতা অর্জন করা না গেলে কার্যকর সংসদ চালানো কঠিন হতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয় শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিতে একটি চমকপ্রদ মোড় এনে দিয়েছে। এটি কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নয়; বরং বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্যও একটি বড় ইঙ্গিত।
শিক্ষার্থীদের দাবি—জাকসু যেন হয় সকলের জন্য উন্মুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দলীয় স্বার্থ নয় বরং শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানই হবে প্রধান লক্ষ্য। এখন দেখা বাকি—শিবির তার বিজয়কে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে এবং শিক্ষাঙ্গনের জন্য কী নতুন বার্তা দেয়।