কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে মৌলিক পরিবর্তন আসবে না
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক জটিল মোড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও সমঝোতার চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শনিবার (১৩ আগস্ট) বিকেলে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন
আলী রীয়াজ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে শুধু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তাও মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
তার মতে, এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রক্রিয়া চললেও তা যেন অনন্তকাল ধরে চলতে না পারে। শেষ পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি।
তিনি মনে করেন—
- নির্বাচন দেরি হলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়বে।
- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়তে পারে।
- জনগণের আস্থা দুর্বল হবে।
- আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সংকট কেবল গত ১৬ বছরের নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সমস্যার ফল। তার মতে—
- ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকট গভীর হয়েছে।
- গণতন্ত্রের মূল কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
- শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজন করলেই কার্যকর গণতন্ত্র পাওয়া যাবে না, বরং প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার।
তিনি বলেন, “আমরা ১৯৭৩, ১৯৯১ ও ২০০৯ সালে তিনবার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রত্যাশিত সফলতা পাইনি। এবার যদি কাঠামোগত পরিবর্তন নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে আবারও ব্যর্থ হতে হবে।”
গোলটেবিল বৈঠকে আলী রীয়াজ জোর দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন—
“বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে, অনেক দল সাড়া দিয়েছে। কিন্তু কোনো প্রক্রিয়া অনন্তকাল চলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত একটা চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছানো জরুরি।”
তার মতে, এ সমঝোতা তিনটি ক্ষেত্রে হওয়া উচিত—
- নির্বাচনকালীন সরকারের গঠন
- নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও ক্ষমতা
- রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত সংস্কারের রূপরেখা
আলী রীয়াজ মনে করেন, নির্বাচনের দেরি হলে কেবল রাজনৈতিক স্থবিরতা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও হুমকি তৈরি হবে।
- অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি হলে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে।
- সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
- বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করে, তবে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
তার বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ উল্লেখ করেন, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে ছিল। এর ফলে—
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে।
- বিরোধী দলগুলো কোণঠাসা হয়েছে।
- রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে গেছে।
তিনি মনে করেন, “শেখ হাসিনার ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলেও পরে তা ভেঙে যায়। এর কারণেই এখনকার বিভাজন।”
আলী রীয়াজের মতে, সমাধান হলো—
- রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসতে হবে।
- জনগণের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে, নির্বাচন কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তনের জন্য।
- দীর্ঘমেয়াদে একটি কনসলিডেটেড ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা দিতে হবে।
তিনি বলেন, “আমরা চাই একটি এমন গণতন্ত্র যেখানে নিয়মিত নির্বাচন হবে, বিরোধী দল থাকবে, জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আলী রীয়াজের বক্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার প্রতিফলন।
- কেউ মনে করছেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে তা দেশকে ভয়াবহ অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে।
- আবার কেউ মনে করছেন, কাঠামোগত সংস্কারের এ আহ্বান বাস্তবসম্মত হলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন।
- আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও বারবার বলছেন, সবার অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচন ছাড়া স্থিতিশীলতা আসবে না।
জনগণের মধ্যে বিভক্ত মত দেখা যাচ্ছে।
- এক শ্রেণি মনে করছে, দ্রুত নির্বাচনই জরুরি।
- অন্য শ্রেণি মনে করছে, আগে কাঠামোগত সংস্কার না হলে নির্বাচন অর্থহীন হয়ে যাবে।
- তরুণ প্রজন্ম চাইছে, একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কেবল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, কাঠামোগত সংস্কার, এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠন।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তবে দেশ এক ভয়াবহ অস্থিতিশীলতার দিকে যাবে—এমন সতর্কবার্তাই তিনি দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই সতর্কবার্তা শুনে একসঙ্গে কাজ করবে, নাকি আবারও দেশকে অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে?