আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার আহ্বান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জনমনে নানা আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান জানান। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ভাবা উচিত নয়।”
তার মতে, সততা, শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারলেই জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব। তাই আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশসহ সব বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থেকে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
রাজারবাগে উদ্বোধন হওয়া এই কর্মসূচির আওতায় প্রায় দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, আইনি জ্ঞান, দায়িত্ববোধ ও পেশাগত শৃঙ্খলা আরও জোরদার করা হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “অতীতের ১৪, ১৮ ও ২৪-এর নির্বাচন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে হবে।” তিনি পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান, ধৈর্য ও শৃঙ্খলার সঙ্গে আইনানুগভাবে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা বা প্রভাব খাটানোর যেকোনো চেষ্টাকে রুখে দেওয়ার জন্য তিনি কঠোর নির্দেশ দেন।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, নির্বাচনের আগে পুলিশের পোস্টিং বা দায়িত্ব বণ্টন লটারির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এর ফলে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রভাব খাটাতে পারবে না।
এ সিদ্ধান্তকে তিনি ‘স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পুলিশকে সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধেও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। বিশেষ করে মাদক, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর হতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে পুলিশকে বাড়তি দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে, যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার কোনো অপচেষ্টা সফল না হয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বলেন, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষতা একটি দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিশ্চিত করতে পারে। বাংলাদেশ পুলিশকেও এমন মানদণ্ড তৈরি করতে হবে, যাতে তারা কেবল জাতীয় আস্থাই নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও অর্জন করতে সক্ষম হয়।
তিনি সতর্ক করে বলেন, “কিছু বিচ্যুতিই পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। ব্যর্থতাগুলো দ্রুত প্রচারিত হয়, কিন্তু সাফল্যগুলো ততটা আলোচিত হয় না। তাই সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
সম্প্রতি রাজবাড়ীতে সংঘটিত এক ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং ইতোমধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে তিনি সতর্ক করেন। এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট বার্তা দেন—কোনো অপরাধী বা অনিয়মকারী পুলিশের ছত্রছায়ায় থাকবে না।
অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, আসন্ন নির্বাচন হবে পুলিশের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বক্স চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই নির্বাচনী দায়িত্বে পুলিশের নিরপেক্ষতার ওপর জোর দেন এবং এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে ‘সময়ের দাবি’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে বারবারই প্রশ্ন ওঠে—আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না। অতীতে একাধিক নির্বাচনে অভিযোগ এসেছে যে, পুলিশ কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিতর্কিত ভূমিকা নিয়েছে।
তবে বর্তমান উদ্যোগ প্রমাণ করছে, এবার সরকার ও প্রশাসন চাইছে ভিন্নধর্মী একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। যদি পুলিশ সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ থাকে, তবে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আস্থা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও নির্ভরশীল।
- ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- সহিংসতা প্রতিরোধ করা
- ভোটারদের নিরাপদ পরিবেশ প্রদান
- রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা
এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। তাই পুলিশ বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা এখন সময়ের দাবি।
জনগণ চায়, তারা যেন কোনো ভয়-ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এজন্য পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক চাপ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যদি তারা কাজ করে, তবে এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে
রাজারবাগে পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, এ নির্বাচন হবে ভিন্নমাত্রার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে কেবল জনগণের স্বার্থে কাজ করতে হবে।
পোস্টিং লটারির মাধ্যমে করা, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা এবং সর্বোপরি স্বচ্ছতা বজায় রাখাই হবে পুলিশের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ পুলিশ যদি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে, তবে তারা শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে সক্ষম হবে।