তারেক রহমান বললেন ‘স্বাধীন বিবেকের প্রতীক’
বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক এবং বামপন্থী রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর-এর মৃত্যুতে গভীর শোক নেমে এসেছে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে। রবিবার সকালে (৪ সেপ্টেম্বর) ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও লেখক।
তার মৃত্যুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আলাদা শোকবার্তায় শোক প্রকাশ করেছেন। তারা উমরকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও চিন্তার জগতে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করেছেন।
বদরুদ্দীন উমরের জীবনকে বহুমাত্রিক বলা চলে। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অংশগ্রহণকারী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তার লেখনিতে উঠে এসেছে কৃষক-শ্রমিক, শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কথা। বামপন্থী আদর্শে দৃঢ় থেকে তিনি আজীবন স্বৈরতন্ত্র ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অসংখ্যবার রাজরোষে পড়লেও তিনি তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হননি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শোকবার্তায় বদরুদ্দীন উমরকে “স্বাধীন বিবেকের প্রতীক” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন—
“বারবার রাজরোষে পড়লেও তিনি আদর্শ বাস্তবায়নে আপোষহীন ছিলেন। কোনো ভীতি কিংবা হুমকি তাকে তার কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। স্বৈরাচারকে উপেক্ষা করে তিনি সবসময় স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি ছিলেন সত্যিকারের নির্ভীক বুদ্ধিজীবী।”
তারেক রহমান আরও বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বদরুদ্দীন উমরের ভূমিকা ছিল অমলিন। তার গবেষণাধর্মী গ্রন্থগুলোকে তিনি “জাতির ক্রান্তিলগ্নের অমূল্য সম্পদ” হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন—
“বদরুদ্দীন উমর আমৃত্যু জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করেছেন এবং কলম ধরেছেন। রাজনীতির দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার মতো একজন নির্ভীক মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীর বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি ছিল।”
ফখরুল আরও বলেন, তার লেখনী কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণা ছিল। বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও তিনি কখনো ব্যক্তিস্বার্থে আপোষ করেননি। সহজ-সরল জীবনযাপন ও সত্যের পক্ষে অবস্থান ছিল তার জীবনের মূল বৈশিষ্ট্য।
বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে শুধু বিএনপি নয়, দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি ও বাম মহলেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে লিখেছেন যে, উমরের মতো একজন মুক্তচিন্তার মানুষ এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
বামপন্থী নেতারা মনে করছেন, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তার গবেষণামূলক গ্রন্থগুলোতে যে ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায়, তা আগামী প্রজন্মকে সত্যিকারের ইতিহাস জানাতে সাহায্য করবে।
বদরুদ্দীন উমর শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন এবং অসংখ্য বই লিখেছেন। তার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল মূলত ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও রাজনীতি।
- ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ তার রাজনৈতিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
- স্বাধীনতা আন্দোলন: মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি বামপন্থী চিন্তাবিদ হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।
- গবেষণা ও লেখালেখি: তার রচিত বইগুলো ইতিহাস ও রাজনৈতিক গবেষণায় অমূল্য অবদান রেখেছে। বিশেষ করে কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে তার কাজগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলো ছড়াবে।
বদরুদ্দীন উমরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার আপোষহীন মনোভাব। তিনি কখনোই ক্ষমতাসীন শাসকের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। বারবার তাকে গ্রেপ্তার, হয়রানি ও হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে, কিন্তু তিনি নিজের মত প্রকাশে পিছপা হননি।
এ কারণেই অনেকেই তাকে “স্বাধীন বিবেকের প্রতীক” হিসেবে উল্লেখ করেন। তার জীবন দেখিয়েছে, একজন বুদ্ধিজীবী কীভাবে সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকতে পারেন।
তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল উভয়েই মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তারা মনে করেন, বদরুদ্দীন উমরের জীবন থেকে প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে।
তারেক রহমান বলেন—
“উমর সাহেবের মতো মানুষ এই জাতির জন্য দিশারি ছিলেন। তার চিন্তা ও লেখনি আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে।”
বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারালো এক প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, নির্ভীক বুদ্ধিজীবী এবং আপোষহীন রাজনীতিবিদকে। তার জীবনের সংগ্রাম, গবেষণা ও আদর্শ আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার মতো বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের শূন্যতা আরও প্রকট হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে তার রেখে যাওয়া বই, গবেষণা এবং কর্মধারা বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার ইতিহাসে স্থায়ীভাবে আলো ছড়াবে।