আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ নেমে গেল ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও বড় ধরনের ধাক্কা খেল এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) বিল পরিশোধের কারণে। নিয়মিত এই আমদানি বিল পরিশোধের চাপের ফলে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ হিসাব অনুযায়ী এই রিজার্ভ আরও কমে গিয়ে নেমেছে ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আকুতে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার (১.৫ বিলিয়ন) পরিশোধ করার পরপরই বৃহস্পতিবার রিজার্ভে বড় ধরনের পতন ঘটে। বিপিএম-৬ অনুযায়ী, যা ২৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে আসে ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে।
আকু বা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন হচ্ছে একটি আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা, যার সদস্য এশিয়ার ৯টি দেশ। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দুই মাসের আমদানি-রপ্তানির হিসাব সমন্বয় করা হয়। অর্থাৎ, এই সময়কালে কোনো দেশ আমদানি বাবদ অন্য দেশের কাছে যত ডলার পাওনা হয়, সেই অর্থ একসঙ্গে দুই মাস শেষে পরিশোধ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের মে ও জুন মাসে আকুতে ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। আর জুলাই ও আগস্টে পরিশোধ করা হলো প্রায় ১৫০ কোটি ডলার। যদিও আগের সময়ের তুলনায় আমদানির চাপ কিছুটা কমেছে, তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এর প্রভাব স্পষ্ট।
আকুর আওতায় থাকা দেশগুলো হলো—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইরান। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির লেনদেনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বড়।
বিশেষ করে ভারতের বাজার থেকে আমদানির কারণে আকুতে বাংলাদেশের বিলের চাপ সব সময়ই বেশি থাকে। চীন আকুর সদস্য না হলেও ভারতের সঙ্গে আমদানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় আকু বিল পরিশোধে বাংলাদেশকে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন—
“বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম-৬ অনুযায়ী তা দাঁড়িয়েছিল ২৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আকু বিল পরিশোধের কারণে বৃহস্পতিবার রিজার্ভ প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।”
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ আরও কম দেখানো হয়। কারণ এই হিসাবপদ্ধতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট রাখা কিছু অর্থ (যেমন এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, এলসি মার্জিন ইত্যাদি) প্রকৃত রিজার্ভের মধ্যে ধরা হয় না।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, নিয়মিত আকু বিল পরিশোধ ও ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভে ওঠানামা অব্যাহত থাকবে। যদিও আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে, তবে বিলাসী পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় খাতে আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
তাদের মতে, রিজার্ভ ধরে রাখতে হলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। কারণ আমদানি বিলের চাপ নিয়মিত থাকবে, অথচ আয় বাড়াতে না পারলে রিজার্ভের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠবে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন,
“রিজার্ভ ধরে রাখার মূল উপায় হলো ডলার আয়ের উৎস বৃদ্ধি করা। প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা বাড়ানো হলেও তা স্থায়ী সমাধান নয়। রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করা এবং নতুন বাজার খোঁজা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে রিজার্ভ শক্তিশালী হবে না।”
রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ: আমদানির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনা এবং কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে।
- রেমিট্যান্সে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা: প্রবাসী আয়কে উৎসাহিত করতে ২.৫% হারে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
- রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আনা বাধ্যতামূলক করা: রপ্তানিকারকদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয় দেশে ফেরত আনতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
- নতুন বাজার খোঁজা: পোশাক শিল্পের পাশাপাশি আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে নতুন বাজারে প্রবেশের চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত আকু বিল পরিশোধের ফলে রিজার্ভ ওঠানামা করবে। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রিজার্ভকে অন্তত ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রাখা
তাদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ থাকলেও রিজার্ভের স্তর এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। বরং সঠিক নীতিমালা গ্রহণ করলে আগামী দিনে এটি আরও স্থিতিশীল করা সম্ভব।
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট বর্তমানে অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়মিত আকু বিল পরিশোধ ও আমদানির চাপ রিজার্ভকে নাড়া দিলেও সরকারের উদ্যোগ এবং প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে সমাধান চাইলে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে এবং নতুন রপ্তানি খাত গড়ে তুলতে হবে। নইলে রিজার্ভের এই ওঠানামা বারবার দেশের অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলবে।