নারী শিক্ষার্থীর ছবি তোলাকে ঘিরে সমালোচনার ঝড়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে যখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে ক্রীড়া সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থী আরমান হোসেনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে আরমানের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ সরাসরি মুখোমুখি করা হয়। অভিযোগ ছিল— তিনি অনুমতি ছাড়াই এক নারী শিক্ষার্থীর ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি গ্রুপে শেয়ার করেছেন। এ ঘটনায় অনুষ্ঠানেই নারী শিক্ষার্থীর তোপের মুখে পড়েন তিনি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক নারী শিক্ষার্থী প্রশ্ন তোলেন,
“আপনাদের ইশতেহারে অন্যতম দাবি মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগে আপনার নামে অভিযোগ উঠেছিল, আপনি জিমে একটি মেয়ের ছবি তুলে গ্রুপে পোস্ট করেছেন। যখন আপনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি বলেছেন পাবলিক প্লেসে ছবি তুলতেই পারেন। অথচ এটা বোঝেননি যে কোনটা সুরক্ষা, আর কোনটা হয়রানি।”
নারী শিক্ষার্থীর এই প্রশ্নে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
এই প্রশ্নের উত্তরে আরমান বলেন—
“ওইটা আমাদের ছেলেদের জিমের টাইমে ছিল, যেখানে কর্মচারীরা চেয়ার বসিয়ে রাখে। মেয়ে টেবিলে পা তুলে মোবাইলে কথা বলছিল। আমি এমনভাবে ছবি তুলেছি যাতে মুখ দেখা না যায়। গ্রুপে পোস্ট করেছি যেন আর কেউ এমন না করে।”
তিনি আরও যুক্তি দেন, ছবিতে কোনো মুখ স্পষ্ট দেখা যায়নি। বরং তিনি দায়িত্বশীলভাবে সবাইকে সতর্ক করতে ছবিটি দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্নকারী নারী শিক্ষার্থী জবাব দেন, “আপনি আমাদের কাছে এসে বলতে পারতেন। অথচ অনুমতি ছাড়া ছবি তুলে গ্রুপে পোস্ট করেছেন। পারমিশন ছাড়া ছবি তোলা হেনস্তা।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্য প্রার্থীরাও আরমানকে সমালোচনা করেন। একজন প্রার্থী বলেন,
“আপনি যদি সতর্ক করতে চান, তবে ছবিটি না তুলে সরাসরি গিয়ে বলতে পারতেন। আপনার যদি ছোটবোন হতো, তাকেও কি একইভাবে ছবি তুলে গ্রুপে পোস্ট দিতেন?”
আরেকজন বলেন, “ছবি তুলে পোস্ট করা যায়, কিন্তু কাছে গিয়ে বলা যায় না— এমন দ্বিমুখী আচরণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না।”
আরমান এতে কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হন। ফলে বিতর্ক আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
বিতর্ক সত্ত্বেও আরমান হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া অঙ্গনে পরিচিত একটি নাম। ২০২৪ সালে তিনি জুডোতে ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন। নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য নানা প্রতিশ্রুতি দেন।
তার ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো—
- মেয়েদের হলে প্রতিবছর সেলফ-ডিফেন্স প্রশিক্ষণ চালু করা।
- শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের বৈষম্য নিরসন।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ সংস্কার।
- বার্ষিক ক্রীড়া পঞ্জিকা তৈরি ও জিমনেশিয়াম সমৃদ্ধ করা।
- প্রতিটি হলে মিনি জিমনেশিয়াম চালু করা।
- শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট তৈরি।
- অনলাইন ফি প্রদানের ব্যবস্থা।
- ইনডোর গেমস সেন্টারে স্মার্ট কার্ড পাঞ্চ সিস্টেম ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন।
- কোটা ভিত্তিক খেলোয়াড়দের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ নীতি প্রণয়ন।
- আন্তঃহল ও আন্তঃবিভাগীয় প্রতিযোগিতার বাজেট বৃদ্ধি।
এই প্রতিশ্রুতিগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও, ছবি তোলার বিতর্ক তার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
ঢাবির বিভিন্ন হলের নারী শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার সমালোচনা করেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, এমন আচরণ ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতায় গেলে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে তবে কী হবে?
একজন ছাত্রী বলেন, “আমাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছেন, অথচ নিজেই হেনস্তার মতো কাজ করেছেন। এটা খুবই দ্বিচারিতা।”
আরেকজন বলেন, “ছবি তুলে গ্রুপে পোস্ট করা আমাদের সম্মানহানি করে। নেতিবাচকভাবে হলেও এটি হয়রানির শামিল।”
ডাকসু নির্বাচন সব সময়ই দেশের ছাত্ররাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে লড়াই করা কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষার্থীরা এখন ভাবছে— একজন প্রার্থী যদি সচেতনভাবেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষা করতে না পারেন, তবে তার কাছ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা কীভাবে আশা করা যায়?
বিশ্লেষকদের মতে, আরমানের প্রতিশ্রুতিগুলো খেলাধুলা ও অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ। তবে নির্বাচনে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মানই বড় ভূমিকা রাখে। একজন প্রার্থীর ব্যক্তিগত আচরণই তার প্রতি আস্থার ভিত্তি তৈরি করে।
ঢাবির একজন সাবেক ডাকসু নেতা বলেন, “ডাকসুতে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে প্রথম শর্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করা। খেলাধুলা বা অবকাঠামোর প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, যদি আচার-আচরণে ত্রুটি থাকে তবে শিক্ষার্থীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে শিবির সমর্থিত প্রার্থী আরমান হোসেনকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক স্পষ্ট করে দিয়েছে— শিক্ষার্থীরা শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে খুশি হয় না। তাদের কাছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অনুমতি ছাড়া ছবি তোলার ঘটনা হয়তো কারও কাছে সামান্য মনে হতে পারে, তবে শিক্ষার্থীরা এটিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ এবং হয়রানি হিসেবে দেখছেন। আরমানের ইশতেহার শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করলেও, এই বিতর্ক তার নির্বাচনী যাত্রাকে জটিল করে তুলতে পারে।