সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের একযুগ পার হলেও বিচার এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। এই দীর্ঘ সময় ধরে বিচার প্রক্রিয়ায় যে দেরি হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু একসময় যে তথ্যগুলো সামনে আসেনি, সেগুলো এখন প্রকাশ্যে আসছে। বিশেষ করে সামিট গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পটভূমি
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। এই ঘটনার পর থেকেই তদন্তের দায়িত্ব নেয় গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। কিন্তু এক দশক পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়নি। বিচারহীনতার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে।
সামিট গ্রুপের সম্ভাব্য জড়িত থাকার তথ্য
প্রথমে উল্লেখ করা দরকার যে, মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলায় কাজ করতেন এবং তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি বিষয়ক রিপোর্ট তৈরি করছিলেন, যা সামিট গ্রুপের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। সামিট গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী, যারা জ্বালানি, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। রুনির তৈরি করা রিপোর্টটি প্রচারের আগেই এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান তা আটকে দেন, যা সেই সময়ে মিডিয়ার ভেতরে-বাইরে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
হত্যাকাণ্ডের রাতে
হত্যাকাণ্ডের রাতে এটিএন বাংলার পরিচালক মাকসুদুর রহমান রঞ্জুকে সাগর-রুনি’র ফ্ল্যাটে পাঠানো হয়, সাগরের ল্যাপটপ উদ্ধার করার মিশন নিয়ে। এই ল্যাপটপে রুনির তৈরি করা সেই রিপোর্টের সব তথ্য ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। রঞ্জুর সাথে এই কাজের জন্য ভাড়াটে খুনিরাও নিয়োগ দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পরদিন রঞ্জু গ্রেফতার হলেও মাহফুজুর রহমান তার প্রভাব খাটিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন। এর একদিন পরই রঞ্জু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সামিট গ্রুপের আরো প্রভাব
সামিট গ্রুপের জ্বালানি খাতে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি টেলিযোগাযোগ খাতেও তাদের জড়িত থাকার তথ্য সামনে আসে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে যে আন্তর্জাতিক লং ডিস্ট্যান্স টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিসেস পলিসি গ্রহণ করা হয়, তা সামিট গ্রুপের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। এই পলিসির মাধ্যমে সামিট গ্রুপকে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (IIG), ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (NTTN), ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ, ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (ITC), এবং ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (ICX) সহ বিভিন্ন সার্ভিসের মাধ্যমে একটি বড় মার্কেট শেয়ার প্রদান করা হয়।
এভাবে সরকার সামিট গ্রুপকে টেলিযোগাযোগ খাতে একটি মনোপলি সৃষ্টি করার সুযোগ দেয়, যা ইন্টারনেটের দাম এবং গুণগতমানের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই কারণে, বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম এবং গুণগতমান বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক নিম্নমানের। এই মিডলম্যান কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাও পেয়ে যায়।
সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা
সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আজিজ খান, যিনি বাংলাদেশের প্রথম বিলিয়নেয়ার এবং বর্তমানে তার নেট ওর্থ ১.১ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল সম্পদের পেছনে সরকারের বিশেষ সহায়তার প্রভাব রয়েছে, যা আজিজ খান এবং তার গ্রুপকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করতে সহায়তা করেছে। আজিজ খানের সম্পদ বাড়াতে সাহায্য করেছে সামিট গ্রুপের বিভিন্ন খাতে আধিপত্য বিস্তার এবং সরকারে সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
হত্যাকাণ্ড এবং সামিট গ্রুপের সম্ভাব্য সংযোগ
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাথে সামিট গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তা খুবই উদ্বেগজনক। সামিট গ্রুপের স্বার্থের বিপরীতে থাকা কোনো তথ্য ফাঁস হলে তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সেটির একটি উদাহরণ হতে পারে।
এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই হয়তো সামিট গ্রুপের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা রক্ষিত। সরকারের মদদে এই হত্যাকাণ্ডে যারা প্রকৃতভাবে জড়িত, তাদেরকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ প্রকাশ্যে আসছে না।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, তা যেন শেষ না হয়। সামিট গ্রুপের সাথে এই হত্যাকাণ্ডের জড়িত থাকার বিষয়টি আরও গভীরভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা এবং দোষীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা। গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো, এই বিচারহীনতার প্রহসনের দ্রুত অবসান হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।