ডেস্ক রিপোর্ট:
শুধু আওয়ামী লীগের সহযোগী দল হওয়ার অভিযোগ নয়, জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিষিদ্ধ করার দাবির পেছনে লুকিয়ে আছে আসন্ন নির্বাচনের ভোটের হিসাবও। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধী দলের অবস্থান ও সংসদীয় সমীকরণে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পক্ষ এই ইস্যুটি সামনে এনেছে।
বিএনপি ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করেছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। তাদের মতে, জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে— কে অপরাধী আর কে নয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দাবি তুলেছে জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দেওয়ার। এমনকি গণঅধিকার পরিষদ এ দাবিতে কর্মসূচি পালন করে, যেখানে লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন দলের সভাপতি নুরুল হক নুর।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর ছিল। তাদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।”
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মন্তব্য করেন, “কোনো দলের বিষয়ে জনগণই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমান কখনোই এভাবে নিষিদ্ধকরণের পথে হাঁটেননি।”
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, জামায়াতের আশঙ্কা হলো— জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ভোট জাপার ঘরে পড়তে পারে। তাতে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা হারাতে পারে জামায়াত। তাই বিভক্ত এবং দুর্বল জাতীয় পার্টিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এখনকার পরিস্থিতি মূলত “ভোটের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল।” সংখ্যানুপাতিক আসন (পিআর) বণ্টন নিয়েও বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। জামায়াত বলছে, পিআর না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। অপরদিকে বিএনপি পিআরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী সমকালকে বলেন, “একটি পক্ষ জাতীয় পার্টিকে প্রতিপক্ষ মনে করে এ ধরনের অনৈতিক দাবি তুলেছে। আমাদের অভিজ্ঞতা, জনসমর্থন ও পরিচিতি রয়েছে। আর এ কারণেই নির্বাচনে আমাদের প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এক দলের ভোট আরেক দল কখনো পায় না। এমন উদ্ভট আশঙ্কা থেকে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা যায় না। প্রয়োজনে আইনগতভাবে মোকাবিলা করব।”
ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠ
- নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, “জাতীয় পার্টি গণতন্ত্র ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছে ঠিকই, কিন্তু এভাবে হঠাৎ নিষিদ্ধ করার দাবি সঠিক নয়।”
- গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, “জনগণের রায়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। মব-রাজনীতির মাধ্যমে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।”
- গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, “আমরা শুধু জাতীয় পার্টি নয়, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পুরো ১৪ দলকেই নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছি। এরা গণতন্ত্র হত্যার জন্য দায়ী।”
ঐতিহাসিক ভোটের পরিসংখ্যান
- ১৯৮৬: জাতীয় পার্টি ৪২.৩% ভোট, জামায়াত ৪.৫৪%।
- ১৯৮৮: জাপা ৬৮.৪% ভোটে সরকার গঠন।
- ১৯৯১: জাপা ১১.৯%, জামায়াত ১২.১৩% ভোট।
- ২০০১: জাপা ৭.২২%, জামায়াত ৪.২৮% ভোট (বিএনপির সঙ্গে জোটে ১৭ আসন)।
- ২০০৮: জাপা ৭%, জামায়াত ৪.২৮% ভোট।
- ২০১৪: জাপা ১১.৩১% ভোট, ৩৪ আসন (বিএনপি বর্জন করে)।
- ২০১৮: জাপা ২২ আসন, ভোট মাত্র ৭%।
- ২০২৪ (দ্বাদশ সংসদ): জাপা মাত্র ১১টি আসন, আওয়ামী লীগের ছাড়ের পরও ২৩৭ আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি মূলত নির্বাচনী কৌশল। জামায়াত বিরোধী দল হওয়ার পথে বাধা দূর করতে চাইছে, অন্যদিকে বিএনপি গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নিষিদ্ধকরণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সবশেষে সিদ্ধান্ত হবে ভোটের মাঠেই— জনগণই ঠিক করবে কোন দল টিকে থাকবে আর কোন দল বাতিল হবে।