কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদে আবারও দানের রেকর্ড
বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাসে দানের জায়গা নিয়ে যে মসজিদ সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, সেটি হলো কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী পাগলা মসজিদ। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এ মসজিদটি দেশের মানুষের কাছে দানের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রতি কয়েক মাস অন্তর অন্তর দানবাক্স খোলা হয় এবং প্রতিবারই নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। সর্বশেষ শনিবার (৩০ আগস্ট) সকাল ৭টা থেকে শুরু করে রাত সোয়া আটটা পর্যন্ত টানা ১৩ ঘণ্টার গণনা শেষে পাওয়া গেছে এক অভূতপূর্ব রেকর্ড— ১২ কোটি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ২২০ টাকা নগদ অর্থ। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি পাওয়া গেছে স্বর্ণালঙ্কার, রূপা এবং বৈদেশিক মুদ্রা।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থে কেবল একটি মসজিদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডই নয়, বরং সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। ফলে পাগলা মসজিদ এখন শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়, বরং মানুষের বিশ্বাস, আবেগ ও কল্যাণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
শনিবার সকাল ৭টা। কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের ১৩টি লোহার দানবাক্স খোলার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ টাকা। চারপাশে উপস্থিত শত শত মানুষের চোখে-মুখে বিস্ময় আর আনন্দের ঝিলিক। গণনার কাজ চলে মসজিদের দ্বিতীয় তলায়। সেখানে টাকার বস্তা ভর্তি করার কাজ চলে পুরো দিনব্যাপী। টানা ১৩ ঘণ্টা গণনার পর রাত ৮টার দিকে প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত হিসাব।
ফলাফল হলো— এবার দান থেকে পাওয়া গেছে ১২ কোটি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ২২০ টাকা নগদ অর্থ। শুধু নগদ টাকা নয়, এর সঙ্গে পাওয়া গেছে স্বর্ণালঙ্কার, রূপা, বৈদেশিক মুদ্রা, এমনকি পশু-পাখিও। ৩২টি বস্তায় ভরে রাখা হয় কেবল কাগজের নোট। এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য মূল্যবান দ্রব্য।
পাগলা মসজিদের দানের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও এবারই সর্বাধিক অর্থ জমা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ১২ এপ্রিল দানবাক্স খোলা হয়েছিল। তখন পাওয়া যায় ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ টাকা। কিন্তু এবারের ১২ কোটির বেশি টাকায় সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস তৈরি হলো।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান বলেন,
“দানকারীদের বিশ্বাস, এখানকার দানে পূর্ণ হয় মনোবাসনা। অনেকে সুস্থতা, সুখ ও মনের শান্তির জন্যও দান করেন। শুধু মুসলমান নয়, সব ধর্মের মানুষ এখানে দান করে থাকেন। নগদ টাকার পাশাপাশি অনেকে দেন গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিও।”
এত বিপুল পরিমাণ অর্থ গণনা ও সংরক্ষণের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। পুরো গণনা কার্যক্রমে অংশ নেন সাড়ে চার শতাধিক কর্মী। এর মধ্যে ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদের কর্মচারী, মাদরাসার ছাত্র ও অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক।
তদারকিতে ছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বে ছিলেন সেনা, পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যরা। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী জানান—
“গণনা প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই মসজিদের টাকা গণনা করা সম্ভব হয়েছে।”
প্রথমবারের মতো এবার পাগলা মসজিদে চালু করা হয়েছে অনলাইন দান প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমে এসেছে আরও ৫ লাখ টাকার বেশি অনুদান। আধুনিক প্রযুক্তির এই সংযোজন মসজিদের দান কার্যক্রমকে আরও আন্তর্জাতিক মানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা সহজেই দান করতে পারবেন। ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে এবং দেশের বাইরে থেকেও কোটি কোটি টাকা আসবে এই তহবিলে।
পাগলা মসজিদের তহবিলে বর্তমানে প্রায় শতকোটি টাকা জমা রয়েছে। ব্যাংকে জমা রাখা এই অর্থের সুদ ও লভ্যাংশ থেকে পরিচালিত হয় নানামুখী জনকল্যাণমূলক কাজ।
- ক্যান্সার, কিডনি ও জটিল রোগে আক্রান্ত দরিদ্র রোগীদের আর্থিক সহায়তা
- শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, বিশেষ করে মাদরাসা ও এতিমখানা পরিচালনা
- অসহায় মানুষের চিকিৎসা ও সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রম
- ধর্মীয় শিক্ষা ও গবেষণা
পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দানকৃত অর্থ দিয়ে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের বহুতল ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এই কমপ্লেক্সে থাকবে—
- আধুনিক লাইব্রেরি
- গবেষণা কেন্দ্র
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন কেন্দ্র
- দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র
এর কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান।
পাগলা মসজিদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও দান করে থাকেন। এটি ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হিন্দু, খ্রিস্টান এমনকি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষও নিয়মিত এখানে দান করে থাকেন।
ফলে পাগলা মসজিদ এখন শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সামাজিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
তিনতলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদটির গম্বুজ ও উঁচু মিনার সমৃদ্ধ স্থাপত্য কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে গর্বের বিষয়। পাঁচতলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদ যেন মানুষের ভালোবাসা ও দানের শক্তির সাক্ষ্য হয়ে আছে।
দেশের ভেতরে যেমন এর জনপ্রিয়তা রয়েছে, তেমনি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে পাগলা মসজিদের খ্যাতি। নানা গণমাধ্যমে এটি আলোচনায় এসেছে এবং পর্যটকরাও ভিড় জমাচ্ছেন এখানে।
মসজিদটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বিশ্বাস, আবেগ ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি। অনেকেই মনে করেন, এখানে দান করলে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। অসুস্থ মানুষ সুস্থতা কামনায় এখানে দান করেন, আবার কেউ করেন সংসারের শান্তি কামনায়।
এ কারণেই পাগলা মসজিদ আজ দেশের অন্যতম বিশ্বাস, আবেগ ও দানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আজ সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডের এক বিশাল কেন্দ্র। প্রতি কয়েক মাস পরপর দানবাক্স খোলা হলে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা বিশ্বে বিরল। সর্বশেষ দানে প্রমাণ হলো, মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাসের কাছে সবকিছুই সম্ভব।
১২ কোটি টাকার দান কেবল অর্থের পরিমাণ নয়, বরং এটি মানুষের মনের টান, বিশ্বাস ও দানের সংস্কৃতির প্রতিফলন। সামনে যখন আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মিত হবে, তখন পাগলা মসজিদ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী এক অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে।