নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতির প্রভাব ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনকে ঘিরে নতুন নতুন আলোচনা প্রতিদিনই সামনে আসছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের অবস্থানকে কেমনভাবে কৌশলগতভাবে দাঁড় করাবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল ব্যাপক। সম্প্রতি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা এক টক শোতে জামায়াত ইসলামী এবং সামগ্রিক নির্বাচনী কাঠামো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্তব্য করেছেন।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ভোটের বাক্সে জামায়াতে ইসলামী যে হাইপ (অর্থাৎ প্রচারণা বা উত্তেজনা) তুলছে, সেটার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের বেশ বড় ধরনের ফারাক আছে। রুমিনের মতে, জামায়াতের শক্তিশালী গ্রাসরুট পর্যায়ের সংগঠন থাকলেও বাস্তবতা হলো তাদের অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা প্রচারণা অনেক সময় রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
রুমিন ফারহানার বক্তব্যে উঠে আসে, জামায়াত ইসলামী তাদের কর্মীদের কেবল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ব্যবহার করে না; বরং তারা একেকজনকে “ক্যাডারের মতো” প্রস্তুত করে। এই কর্মীরা অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ এবং “জানবাজি রাখা কর্মী” হিসেবেই মাঠে কাজ করে। এর ফলে তারা স্থানীয় পর্যায়ে শক্ত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই গ্রাসরুট শক্তি আসলে জাতীয় নির্বাচনে কতটা আসনে প্রতিফলিত হতে পারে?
রুমিনের মতে, জামায়াত খুব ভালোভাবেই জানে যে সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা কতটা হতে পারে। বাস্তবতা এবং প্রচারণার মধ্যে বড় ফারাক রেখেই তারা রাজনৈতিক কৌশল সাজাচ্ছে।
রুমিন বলেন, জামায়াত মনে করে নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, তাদের জন্য ততই সুবিধাজনক। কারণ, সময় যত যাবে, তারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নতুন সুযোগ পাবে এবং দরকষাকষির জায়গা বাড়াতে পারবে। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, জামায়াত বিএনপিকে “ম্যালাইন” করার জন্য একটি আলাদা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে, অর্থাৎ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতি অনুসৃত হয়। অর্থাৎ, একটি আসনে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী নির্বাচিত হয়। কিন্তু যদি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) পদ্ধতি চালু হয়, তাহলে নির্বাচনী ফলাফলের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে।
রুমিন ফারহানা উদাহরণ টেনে বলেন,
- ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্টে জামায়াত হয়তো সর্বোচ্চ ২০টি আসন পেতে পারে।
- কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে তারা ৭০ থেকে ৮০টি আসনও পেতে পারে।
এমন একটি পরিস্থিতি দেশের সংসদকে ঝুলন্ত বা হাং পার্লামেন্টে পরিণত করবে। এর ফলে কোনো একক দল সরকার গঠন করতে পারবে না এবং ছোট বা মাঝারি আকারের দলগুলো দরকষাকষির মাধ্যমে বড় রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হবে।
রুমিন ফারহানা আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দল কখনোই মোট ভোটারের ৫১ শতাংশ ভোট পায়নি। অথচ সরকার গঠনের জন্য এটি একটি শর্ত। তার মতে, এই কাঠামোর কারণে ঝুলন্ত সংসদের পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দল অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।
তিনি সতর্ক করে দেন যে, যদি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন চালু হয় এবং জামায়াত বড় আকারে সংসদে প্রবেশ করে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক দরকষাকষির ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু এর ফলে দেশের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং “সাড়ে সর্বনাশ” ঘটতে পারে।
রুমিনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক একেবারে সুস্থির নয়। একদিকে দুই দল বিভিন্ন আন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করেছে, অন্যদিকে বাস্তব রাজনীতিতে জামায়াতের শক্তি ও হাইপ বিএনপিকে চাপের মধ্যে ফেলছে। রুমিনের ভাষায়, জামায়াত বিএনপিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে কাজ করছে। এটি ভবিষ্যতে দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামী সবসময়ই বিতর্কিত একটি নাম। যুদ্ধাপরাধের দায়, রাজনৈতিক সহিংসতায় সম্পৃক্ততা, এবং ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব বিস্তারের কারণে তারা মূলধারার রাজনীতিতে সীমিত জায়গা পেলেও বাস্তবভিত্তিক গণভিত্তি রয়েছে। এই গণভিত্তিই তাদেরকে দরকষাকষির শক্তি জুগিয়ে থাকে।
রুমিন ফারহানার বক্তব্য কেবল একটি রাজনৈতিক সমালোচনা নয়; এটি ভবিষ্যৎ নির্বাচনী কাঠামোর সম্ভাব্য জটিলতাও তুলে ধরে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর বাস্তব শক্তি, এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা প্রতিদিনই ঘনীভূত হচ্ছে। রুমিন ফারহানার বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, শুধু রাজনৈতিক প্রচারণা নয়, বাস্তব ভোটের হিসাব, সাংগঠনিক কাঠামো, এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ধরন—সবকিছুই নির্ধারণ করে দেবে কে কতটা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
তিনি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তা যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে দেশের সংসদ কেবল ঝুলন্ত অবস্থাতেই থাকবে না; বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও গভীর হতে পারে।