সংস্কৃতির দমননীতির বিরুদ্ধে সতর্ক করলেন লেখক ও গবেষক সাদিক কায়েম
বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্বৈরশাসনের পতন ঘটলেও সংস্কৃতির ভেতর যে দমননীতি ও ফ্যাসিবাদী ধারা গেঁথে আছে, তা এখনো বিদ্যমান বলে মন্তব্য করেছেন লেখক ও গবেষক সাদিক কায়েম। তার মতে, কেবল রাজনৈতিক ফ্যাসিস্টদের পতনেই সমাজ মুক্ত হয় না; বরং সংস্কৃতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করা না গেলে একটি জাতি সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) রাজধানীতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক ফ্যাসিস্টরা হয়তো পালিয়েছে বা তাদের পতন ঘটেছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম আমাদের ভেতর থেকে যায়। এই দমননীতিই মানুষের চিন্তা, মতপ্রকাশ এবং সৃজনশীলতার উপর অদৃশ্য শৃঙ্খল তৈরি করে রেখেছে।”
সাদিক কায়েম তার বক্তব্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজমের পার্থক্য তুলে ধরেন। রাজনৈতিক ফ্যাসিজম সাধারণত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সেনা, পুলিশ ও প্রশাসনিক যন্ত্র ব্যবহার করে জনগণকে দমন করে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও দীর্ঘস্থায়ী। এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রথার মাধ্যমে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে।
তার মতে, সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম সবচেয়ে ভয়ংকর কারণ এটি মানুষের চিন্তার ভেতরে প্রবেশ করে এবং স্বাধীনভাবে ভাবার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ কারণে মানুষ রাজনৈতিক শৃঙ্খল ভেঙে বের হতে পারলেও সাংস্কৃতিক দমনের জাল থেকে বের হতে পারে না সহজে।
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজমের উদাহরণ হিসেবে সাদিক কায়েম উল্লেখ করেন—
- মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন: সামাজিকভাবে ভিন্ন মত প্রকাশকারীদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
- সাহিত্য ও শিল্পে একচেটিয়াত্ব: নির্দিষ্ট মতাদর্শকেই সাহিত্য ও শিল্পের কেন্দ্রে রাখা হয়, অন্য চিন্তাভাবনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
- ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতা: সমাজে মুক্তচিন্তা বা উদার সংস্কৃতি বিকাশের পরিবর্তে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
- শিক্ষা ব্যবস্থায় দমননীতি: শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তার পরিবর্তে মুখস্থ নির্ভর এবং কর্তৃত্ববাদী মনোভাব তৈরি করা হয়।
রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধারণত দ্রুত হয়। সরকার পরিবর্তিত হয়, আইন পরিবর্তিত হয়, প্রশাসনের কাঠামো বদলায়। কিন্তু সংস্কৃতিগত পরিবর্তন ধীরে ঘটে। মানুষের চিন্তায়, সংস্কৃতির ভেতরে যে দমনমূলক মানসিকতা প্রবেশ করে, তা বহু প্রজন্ম ধরে টিকে যায়।
সাদিক কায়েম বলেন, “রাজনৈতিক স্বৈরশাসক চলে গেলেও তার রেখে যাওয়া সাংস্কৃতিক কাঠামো দীর্ঘ সময় সমাজকে প্রভাবিত করে। একে মোকাবিলা করতে হলে শিক্ষা, সাহিত্য, গণমাধ্যম ও শিল্পের ভেতরে বিপ্লব ঘটাতে হবে।”
তিনি কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন, যা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম থেকে মুক্তির জন্য জরুরি বলে মনে করেন—
- মুক্তচিন্তা ও গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা
- সাহিত্য ও শিল্পে বহুমাত্রিকতা প্রতিষ্ঠা করা
- শিক্ষা ব্যবস্থায় সমালোচনামূলক চিন্তার চর্চা নিশ্চিত করা
- গণমাধ্যমে ভিন্নমতের প্রকাশে সহনশীলতা গড়ে তোলা
- ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতার বিপরীতে মানবিক মূল্যবোধ প্রচার করা
তিনি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও এই প্রসঙ্গ টানেন। ইতালি, জার্মানি কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার স্বৈরশাসকরা রাজনৈতিকভাবে হটিয়ে দেওয়া হলেও তাদের রেখে যাওয়া সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ বহু দশক ধরে সমাজকে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশও সেই বাস্তবতার বাইরে নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা সহজ, কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জন করা অনেক কঠিন। রাজনৈতিক ফ্যাসিস্টদের পতন হলে মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম অদৃশ্য শৃঙ্খলের মতো সমাজকে জড়িয়ে ধরে রাখে। লেখক সাদিক কায়েমের মতে, বাংলাদেশে প্রকৃত মুক্তি পেতে হলে আমাদের সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।