নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সংবিধান বিতর্কে এনসিপির অবস্থান
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন ধারার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে। দলটি প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশের ২৭টি উপজেলায় আয়োজন করছে ‘উঠানের নতুন সংবিধান’ নামে বিশেষ উঠান বৈঠক। এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কথা বলা, নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয়ে মতামত সংগ্রহ এবং গণপরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করা।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “শুক্রবার (২৯ আগস্ট) থেকে তিন দিনব্যাপী এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপে ২৭টি উপজেলায় এটি অনুষ্ঠিত হলেও পর্যায়ক্রমে সারাদেশে সম্প্রসারণ করা হবে।”
রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত সমাবেশ, মিছিল বা গণসংযোগের মাধ্যমে কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। তবে এনসিপির এ উদ্যোগ আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করছে। কারণ, ‘উঠানের নতুন সংবিধান’ নামের এ কর্মসূচি সরাসরি সাধারণ মানুষের উঠানেই আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ শহর, গ্রাম, ইউনিয়ন, পৌরসভা—সব জায়গায় স্থানীয় জনগণকে একত্রিত করে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের ধারণা জনগণের কাছে উপস্থাপন করবে এনসিপি।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা মাঠে যাচ্ছি। সংবিধান কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর দলিল নয়, এটি হতে হবে জনগণের নিজস্ব ইচ্ছার প্রতিফলন।”
এছাড়া তিনি আরও জানান, জনগণের মতামত গ্রহণ করে তা দলীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় পর্যায়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করা হবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “জুলাই সনদ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অথচ সরকার নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এটি জনগণের সঙ্গে সরকারের করা প্রতিশ্রুতির স্পষ্ট ভঙ্গ।”
তিনি দাবি করেন, সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলে দেশে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে। সেই সংকটের দায়ভারও সরকারের ওপর বর্তাবে।
আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “আমরা মনে করি—গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার ও জনগণের মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হলে জুলাই সনদকে প্রথমে বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে বৈধতার সংকট দেখা দেবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তুলনামূলকভাবে নতুন একটি রাজনৈতিক দল হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তারা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় এসেছে। দলের মূল দর্শন হলো—
- নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা
- গণতন্ত্রকে টেকসই করা
- জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে নতুন সংবিধান প্রণয়ন
- এবং শাসন ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা
এনসিপির নেতারা মনে করেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে প্রত্যাশিত অংশগ্রহণ করতে পারছে না। তাই তারা বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে জনগণের মতামতকে সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে চায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। তবে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন বা সংশোধনের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায়নি। এনসিপি এবার সেই উদ্যোগ নিতে চায়।
‘উঠানের নতুন সংবিধান’ কর্মসূচি মূলত তিনটি ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে—
- প্রথম ধাপ: ২৭টি উপজেলায় বৈঠক করে সাধারণ মানুষের মতামত সংগ্রহ।
- দ্বিতীয় ধাপ: জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সংগৃহীত মতামত বিশ্লেষণ করে খসড়া প্রণয়ন।
- তৃতীয় ধাপ: জাতীয় পর্যায়ে গণসম্মেলনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের প্রস্তাব উত্থাপন।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা চাই জনগণ নিজেরাই বলুক—তারা কেমন সংবিধান চায়, কেমন নির্বাচন ব্যবস্থা চায় এবং কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এনসিপি কেবল সেই মতামতকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রূপ দিতে কাজ করবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির এ ধরনের উদ্যোগ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়েছে। এনসিপির মতো দলগুলো যদি সত্যিই মাঠে গিয়ে জনগণের কথা শোনে, তাহলে এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “শুধু আলোচনা করলেই হবে না। সংগৃহীত মতামতকে বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট রোডম্যাপ থাকতে হবে। তা না হলে এই উদ্যোগও কেবল প্রতীকী পর্যায়েই সীমিত থাকবে।”
সরকারি মহল থেকে এ বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য আসেনি। তবে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা বেসরকারিভাবে বলেছেন, এনসিপির এ ধরনের কর্মসূচি মূলত তাদের রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার কৌশল।
তাদের মতে, নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি এখন অগ্রাধিকার নয়। বরং বিদ্যমান সংবিধান মেনে নির্বাচন সম্পন্ন করাই জরুরি।
টাঙ্গাইলের এক কৃষক এনসিপির উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, “আমরা তো সাধারণ মানুষ। ভোট ছাড়া আর কোনো জায়গায় আমাদের মতামত নেওয়া হয় না। যদি সত্যিই তারা আমাদের কথা শুনতে চায়, তাহলে এটা ভালো উদ্যোগ।”
ঢাকার এক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, “সংবিধান নিয়ে এতদিন শুধু রাজনীতিবিদদের কথাই শুনেছি। এবার যদি সত্যিই জনগণকে নিয়ে কাজ হয়, তাহলে দেশের জন্য তা শুভ হবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির ঘোষিত ‘উঠানের নতুন সংবিধান’ কর্মসূচি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার এ উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন, অন্যদিকে এর বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ ধরনের কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ কেবল রাজনৈতিক দল নয়, গোটা জাতির জন্য নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে।