বৈধ কাগজপত্র ও কর্মসংস্থান অনুমতি না থাকায় বিপাকে শ্রমিকরা
মালয়েশিয়ায় আবারও বৃহৎ পরিসরের অভিবাসন বিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে। দেশটির কেদাহ রাজ্যের পাদাং সেরাইয়ের পাদাং মেহা শিল্প এলাকায় গতকাল বুধবার (২৭ আগস্ট) দিবাগত রাতে পরিচালিত হয় বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন মাহির’। এই অভিযানে মোট ২১৪ জনের কাগজপত্র যাচাই করা হয় এবং এর মধ্যে ১২২ জন অভিবাসীকে আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে ১২১ জন পুরুষ ও একজন নারী রয়েছেন, যাদের বয়স ২২ থেকে ৫৬ বছরের মধ্যে।
ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, অধিকাংশ অভিবাসীর বৈধ পাসপোর্ট বা কর্মসংস্থান অনুমতিপত্র ছিল না। এমনকি অনেকের পাসপোর্টে থাকা নিরাপত্তা স্ট্যাম্পও সন্দেহজনক। বর্তমানে তারা সবাই বেলান্টিক ইমিগ্রেশন ডিপোতে অবস্থান করছেন।
কেদাহ ইমিগ্রেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রিদজুয়ান মোহাম্মদ জাইন জানান, আটক হওয়া অধিকাংশ শ্রমিকের কাছে বৈধ কাগজপত্র ছিল না। যেসব পাসপোর্ট পাওয়া গেছে তার অনেকগুলোতেই নিরাপত্তা স্ট্যাম্প ভুয়া বা সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। কিছু পাসপোর্টের বৈধতা যাচাই এখনো চলছে।
তিনি আরও জানান, আটক শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া নির্মাণ কোম্পানি ও শ্রম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো লিখিত চুক্তি পাওয়া যায়নি। কেদাহ অঞ্চলে যারা কাজ করছিলেন তাদের অধিকাংশের অস্থায়ী ওয়ার্ক ভিজিট পাস (PLKS) কেবল কুয়ালালামপুর অঞ্চলের জন্য বৈধ ছিল। ফলে তাদের অবস্থানই হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধ।
ইমিগ্রেশন বিভাগ জানিয়েছে, Malaysia Digital Arrival Card (MDAC) সিস্টেম ব্যবহার করে আটক অভিবাসীদের ভ্রমণ রেকর্ড যাচাই করা হচ্ছে। বেশিরভাগ পাসপোর্টেই আগমন ও প্রস্থান সংক্রান্ত স্ট্যাম্প থাকলেও গন্তব্যের সুনির্দিষ্ট তথ্য অনুপস্থিত। এর ফলে অভিবাসীদের বৈধতার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযান চলাকালে কিছু অভিবাসী পালানোর চেষ্টা করেন। তাদের এ ধরনের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কর্মকর্তারা। কেদাহ ইমিগ্রেশন বিভাগের পরিচালক স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন—
“অবৈধ অভিবাসীদের নিয়োগ বা আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি নিয়োগকর্তাদের উদ্দেশে সতর্ক করে দেন যেন কেবল বৈধ কাগজপত্রধারী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়।
অভিবাসন বিভাগের তদন্তে দেখা গেছে, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বৈধ চুক্তি ছাড়াই শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা রাজধানী কুয়ালালামপুরের জন্য বৈধ কাগজপত্র নিয়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন। এটি দেশের অভিবাসন আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ।
এই ঘটনায় বেশ কিছু নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন কর্মকর্তারা।
মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রমিকদের একটি প্রধান গন্তব্য। বিশেষ করে নির্মাণ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতে বিদেশি শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে বৈধ ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া অনেক শ্রমিক এখানে আসছেন বা অবস্থান করছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েকটি কারণে মালয়েশিয়ায় অভিবাসী সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে—
- নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা
- দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য
- শ্রমবাজারে সস্তা শ্রমের চাহিদা
- দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা
যদিও অভিবাসন বিভাগ নিয়ম ভঙ্গের কারণে এসব শ্রমিককে আটক করছে, তবুও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, অধিকাংশ শ্রমিক অর্থনৈতিক চাপে পড়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ পথে আসতে বাধ্য হন।
একজন মানবাধিকার কর্মী বলেন—
“এই শ্রমিকরা তাদের পরিবারকে বাঁচাতে সবকিছু ছেড়ে আসেন। কিন্তু কাগজপত্র না থাকার কারণে তাদের জীবন হয়ে যায় দুঃসহ।
মালয়েশিয়ায় আটক হওয়া অভিবাসীদের মধ্যে প্রায়শই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক থাকেন। তবে এই অভিযানে আটক হওয়া ১২২ জনের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ইমিগ্রেশন বিভাগ জানিয়েছে, জাতীয়তার তথ্য পরবর্তী যাচাই শেষে জানানো হবে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যান। তাই এ ধরনের অভিযানে বাংলাদেশি শ্রমিক আটক হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মালয়েশিয়াকে বারবার সতর্ক করেছে যেন শ্রমিকদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়। তবে মালয়েশিয়া সরকার বারবারই বলছে, দেশের শ্রমবাজার ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। দেশটির আইন অনুযায়ী, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থান করলে অভিবাসীদের আটক, জরিমানা এবং বহিষ্কার করা হবে। একই সঙ্গে নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের পাদাং মেহা শিল্প এলাকায় ১২২ অভিবাসী আটক হওয়া নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম আলোচিত ঘটনা। বৈধ কাগজপত্র ও কর্মসংস্থান অনুমতির অভাব শুধু শ্রমিকদের জন্য নয়, নিয়োগকর্তাদের জন্যও বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
ইমিগ্রেশন বিভাগের কঠোর অবস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান করা অভিবাসীদের দিন ফুরিয়ে আসছে। তবে এই পরিস্থিতি শুধু আইন প্রয়োগ দিয়ে নয়, বরং শ্রমবাজারে ন্যায্য নিয়োগ প্রক্রিয়া ও দালাল চক্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব।
আটক হওয়া শ্রমিকদের ভাগ্য এখন নির্ভর করছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের তদন্ত ও আদালতের রায়ের ওপর।