টিভিকে’র জনসভা, বিজেপি বিরোধিতা এবং ভক্ত নির্যাতনের অভিযোগে নতুন আলোচনায় বিজয়
দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক থালাপতি বিজয় একসময় ছিলেন চলচ্চিত্রের আকাশছোঁয়া তারকা। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে তিনি সিনেমা ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে প্রবেশের ঘোষণা দেন। সেই সময় থেকেই তিনি শুধু তার ভক্তদের নয়, বরং ভারতের রাজনৈতিক মহলেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। তবে এবার আলোচনার কারণ শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, বরং এক বিতর্কিত ঘটনা। সম্প্রতি মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত টিভিকে’র (তামিলাগা ভেট্রি কাজাগম) এক সমাবেশে তার দেহরক্ষীদের বিরুদ্ধে ভক্ত নির্যাতনের অভিযোগ উঠে এসেছে। এ ঘটনায় বিজয়সহ তার দেহরক্ষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে কুন্নাম থানায়।
দক্ষিণ ভারতের সিনেমাপ্রেমীরা থালাপতি বিজয়কে চেনেন একজন নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে। দীর্ঘদিনের সফল ক্যারিয়ারে তিনি অসংখ্য ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়েছেন। তবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন তিনি— সিনেমা ছাড়ার এবং পূর্ণ সময় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নাম দেন তামিলাগা ভেট্রি কাজাগম (টিভিকে)।
এই দল ঘোষণার পর থেকে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক জোয়ার সৃষ্টি হয়। বিজয়ের ভক্তরা যেভাবে সিনেমা হলে তার ছবি দেখতে ভিড় জমাতো, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক মঞ্চেও তারা তার পাশে দাঁড়াতে শুরু করে। দল ঘোষণার মাত্র আট মাস পর, ২০২৩ সালের অক্টোবরে, তিনি প্রথমবারের মতো জনসভায় যোগ দেন। সেখানেই তিনি বলেছিলেন— “রাজনীতি সিনেমা নয়, যুদ্ধক্ষেত্র।” এই বক্তব্য দ্রুতই আলোচনার জন্ম দেয়।
২০২৫ সালের আগস্টে মাদুরাই জেলায় টিভিকে’র মহাসমাবেশে যোগ দেন বিজয়। সমাবেশের বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, তিনি আসন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মাদুরাই পূর্ব আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
সেই বক্তৃতায় বিজয় সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি বলেন, বিজেপি হলো টিভিকে’র একমাত্র আদর্শগত শত্রু। একইসঙ্গে তিনি ডিএমকেকে তার দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উল্লেখ করেন। বিজয়ের এ ধরনের বক্তব্য শুধু তার দলের অনুসারীদেরই নয়, বরং পুরো তামিলনাড়ু রাজনীতিকে সরগরম করে তোলে।
তবে এই রাজনৈতিক উত্থানের মাঝেই ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। মাদুরাই সমাবেশের এক পর্যায়ে বিজয়ের এক ভক্তকে তার দেহরক্ষীরা লাঞ্ছিত করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। শরৎকুমার নামে এক ব্যক্তি কুন্নাম থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
তার অভিযোগ, বিজয়ের দেহরক্ষীরা তাকে শারীরিকভাবে আঘাত ও অপমান করেছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে কুন্নাম থানায় মামলা দায়ের হয় বিজয় ও তার দেহরক্ষীদের বিরুদ্ধে। ভারতীয় দণ্ডবিধির তিনটি ধারায় এই মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তের স্বার্থে সব দিক খতিয়ে দেখা হবে।
ইন্ডিয়া টুডে ও এনডিটিভির মতো শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, জনপ্রিয় এই তারকা-রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়ার খবর ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে আলোচনার ঝড় তুলেছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বিজয়ের মতো জনপ্রিয় মুখ যখন রাজনীতির ময়দানে আসেন, তখন তাকে ঘিরে এ ধরনের বিতর্ক অনিবার্য। তবে সমালোচকরা মনে করছেন, একজন রাজনৈতিক নেতার দেহরক্ষীদের এমন আচরণ জনগণের কাছে নেতিবাচক বার্তা দেবে।
বিজয়ের ভক্তরা অবশ্য তাদের প্রিয় নায়ককে নিয়ে এখনো আশাবাদী। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “বিজয়ের মতো নেতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।” কেউ কেউ আবার বলছেন, “একজন নেতাকে সামনে এগোতে হলে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। এই মামলা তার জনপ্রিয়তা কমাতে পারবে না।”
অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের একটি অংশ মনে করছেন, রাজনীতির ময়দানে আসা মানে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, বরং দায়িত্বও বেড়ে যাওয়া। তাই বিজয় ও তার দলকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
বিজয় প্রকাশ্যে বিজেপিকে তার দলের প্রধান আদর্শগত শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি তামিল রাজনীতির প্রভাবশালী দল ডিএমকেকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আখ্যা দিয়েছেন। তার এ ধরনের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, টিভিকে একদিকে জাতীয় রাজনীতির ক্ষমতাধর বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় রাজনীতিতে ডিএমকের সাথেও সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজয়ের এই কৌশল তাকে একদিকে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় করবে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরাসরি দ্বন্দ্ব তৈরি করবে।
একজন অভিনেতা থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা সহজ বিষয় নয়। ইতিহাসে আমরা এমন অনেক উদাহরণ দেখেছি— দক্ষিণ ভারতের এম জি রামচন্দ্রন কিংবা জয়ললিতার মতো তারকারা রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন করেছেন। বিজয়ও কি সেই ধারায় হাঁটবেন?
তামিলনাড়ুর বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, নতুন নেতৃত্বের প্রতি মানুষের কৌতূহল রয়েছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে। বিজয়ের জনপ্রিয়তা, ক্যারিশমা ও তারকাখ্যাতি তাকে রাজনীতিতে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
তবে এই মামলার মতো বিতর্ক তার ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এখন দেখার বিষয়, তিনি কিভাবে এই সংকট সামাল দেন এবং জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখেন।
থালাপতি বিজয় দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা থেকে রাজনীতিক হওয়ার পথে হেঁটেছেন সাহসিকতার সাথে। কিন্তু রাজনীতির পথে হাঁটতে গেলে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, বরং দায়িত্ব, জবাবদিহিতা ও সতর্কতারও প্রয়োজন রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করে যে, জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রাজনীতির ময়দানে নানা রকম ঝুঁকি ও বিতর্ক মোকাবিলা করতে হবে।
তবে ভক্ত-অনুরাগী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজয় যদি সঠিক কৌশল গ্রহণ করেন এবং মানুষের পাশে থাকেন, তবে তিনি তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে সক্ষম হবেন।